শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন। সে জন্য পড়াশোনাও করেছিলেন অনেক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গ্যাংস্টার হয়েছিলেন। আনন্দপাল সিংহকে সমঝে চলতেন রাজস্থানের পুলিশ। আর ‘দেবদূত’ বলতেন রাজপুতেরা। তাঁকে নিয়ে এতটাই ত্রাস ছিল যে, মৃত্যুর পরেও তাঁর দেহে হাত দিতে ভয় পেয়েছিল পুলিশ।
প্রায় ২৪টি ডাকাতি, খুন, অপহরণ করে টাকা হাতানোর মামলায় নাম জড়িয়েছিল আনন্দপালের। তাঁর দলে কাজ করতেন প্রায় ১০০ জন দুষ্কৃতী। অভিযোগ ছিল, অপহৃতদের ছোট একটি খাঁচায় ভরে রাখতেন আনন্দপাল। চালাতেন ভয়ঙ্কর অত্যাচার। সেই গল্প এখনও প্রচলিত রাজস্থানে।
আনন্দপালকে ধরার জন্য পুলিশের একটি দলকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। একটি শহরকে রীতিমতো দুর্গের মতো নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয়েছিল। যদিও এত কিছুর পরেও বহু বার জেল থেকে পালিয়েছিলেন আনন্দপাল।
আদতে রাজস্থানের নাগাউর জেলার লাদনুন তহশীলের সনওয়ারাদ গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন আনন্দপাল।
আনন্দপাল ছোট থেকে শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন। বিএড পাশও করেছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। মাদক চোরাচালান শুরু করেন তিনি।
মাদকের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য খুন করেন জীবনরাম গোদারা নামে এক ব্যক্তিকে। শোনা যায়, জীবনরাম তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।
অপরাধের জগতে প্রবেশের আগে রাজনীতিতেও প্রবেশ করেছিলেন আনন্দপাল। দু’বার নির্বাচনে লড়েছিলেন। দু’বারই নির্বাচনে হেরে যান তিনি। ২০০০ সালে প্রথম বার নির্বাচনে লড়েছিলেন তিনি।
২০০৬ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে মাত্র দু’ভোটে হেরেছিলেন তিনি। প্রাক্তন মন্ত্রী হরজিরান বুরদাকের ছেলের কাছে হেরে গিয়েছিলেন তিনি। এর পরেই অপরাধের জগতে প্রবেশ আনন্দপালের।
অভিযোগ, অপহরণ করে অপহৃতদের ছোট্ট খাঁচায় পুরে রাখতেন তিনি। তার পর চালাতেন অত্যাচার। সেই ভয়ে পরিবারের লোক টাকা দিয়ে যেতেন। ক্রমে আনন্দপালের কুকীর্তির প্রচার হতে থাকে। তাঁর গ্যাংয়ে সদস্য বাড়তে থাকে।
২০১৪ সালে জেলের মধ্যে খুন হয়েছিল আনন্দপালের দীর্ঘ দিনের সহযোগী বলবীর বানুদা। প্রতিশোধ নিতে জেলের ভিতর বিপক্ষ গ্যাংয়ের সদস্যকে খুন করিয়েছিলেন আনন্দপাল। জেলের ভিতরেও অতটাই প্রভাব ছিল তাঁর। তার পর আরও এক বার শিরোনামে এসেছিলেন তিনি।
২০১৫ সালে জেলের রক্ষীদের মাদক মেশানো মিষ্টি খাইয়ে জেল থেকে পালিয়ে যান আনন্দপাল। তার পর দীর্ঘ দিন ফেরার ছিলেন তিনি।
প্রায় দু’বছর পর ২০১৭ সালের জুন মাসে পুলিশ খবর পায়, চুরু জেলায় মৌলাসর গ্রামে লুকিয়ে রয়েছেন তিনি। ২৪ জুন তাঁকে ধরতে অভিযানে নামে পুলিশ। সেই সময়ে পুলিশের সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে মৃত্যু হয়েছিল এই গ্যাংস্টারের।
টানা তিন সপ্তাহ আনন্দপালের দেহ ফ্রিজ়ারে রাখা হয়েছিল। কারণ তাঁর পরিবার দেহ নিতে অস্বীকার করেছিল। তাঁরা আনন্দপালের মৃত্যুতে সিবিআই তদন্তের দাবি তোলেন।
২০১৭ সালের ১২ জুলাই প্রায় দু’লক্ষ মানুষ আনন্দপালের মৃত্যুতে সিবিআই তদন্তের দাবি তুলে থানার সামনে জড়ো হন। বেশির ভাগই ছিলেন রাজপুত। বিক্ষোভ থামাতে গিয়ে আহত হন অন্তত ২০ জন পুলিশ কর্মী। এক প্রতিবাদীর মৃত্যুও হয়েছিল।
এর পরের দিনই পুলিশ-প্রশাসন আনন্দপালের পরিবারকে ডেকে পাঠায়। তাদের কাছে আনন্দপালের দেহ দাহ করার অনুমতি চায়।
অবশেষে আনন্দপালের দেহ দাহ করে পুলিশ। যদিও সেই নিয়েও অভিযোগ উঠেছে। পরিবার দাবি ছিল, পুলিশ জোর করে শেষকৃত্য করেছে আনন্দপালের। যদিও এর পরে ধীরে ধীরে বিষয়টি স্তিমিত হয়ে যায়।
মৃত্যুর বহু বছর পরেও জনমানসে থেকে গিয়েছিলেন আনন্দপাল। তাঁর কেতাদুরস্ত জীবনযাপনের জন্য। তাঁর ঝরঝরে ইংরেজির জন্য।
সমাজমাধ্যমে প্রচুর পোস্ট দিতেন আনন্দপাল। নায়কদের মতো সেজে ছবিও দিতেন। জিম করার অনেক ছবি দিতেন তিনি। বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন।
সাজপোশাকেও খুব সচেতন ছিলেন আনন্দপাল। মাথায় পরতেন বিশেষ টুপি। গায়ে চামড়ার জ্যাকেট। চোখে থাকত ফ্যাশনদুরস্ত চশমা বা রোদচশমা।
আর এক মহিলা ডন অনুরাধা চৌধরির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল আনন্দপালের। তার পর থেকে তাঁর প্রভাব অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল অপরাধ জগতে।
মনে করা হয় আনন্দপালের উত্থানের নেপথ্যে বড় হাত রয়েছে রাজনীতিকদের। নিজেদের স্বার্থেই তাঁকে ব্যবহার করতেন রাজনীতিকরা। আর রয়েছে তাঁর স্বজাতি রাবণ রাজপুতেরা। আনন্দপাল রাবণ রাজপুত সম্প্রদায়ের। সমাজ তাঁদের উচ্চ আসনে বসায় না।
এই সম্প্রদায়ের মানুষ বিয়েতে ঘোড়ায় চাপতে পারেন না। আনন্দপাল তা করেছিলেন। আর সে কারণেই তাঁকে সম্মানের চোখে দেখতেন তাঁর স্বজাতীয়রা। সে কারণে তাঁর মৃত্যুর পর হইচই ফেলে দিয়েছিলেন তাঁরা। সে কারণেই আজও তাঁদের জনমানসে রয়ে গিয়েছেন আনন্দপাল।