২০২২ সালের মাঝামাঝি অর্থনৈতিক সঙ্কটের ছোবলে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল ভারতের পড়শি দেশ শ্রীলঙ্কা। দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশ ছুঁয়েছিল। দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগাড় করাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
অর্থনীতির পরিস্থিতি এতটাই প্রতিকূল হয়েছিল যে, শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে গর্জে ওঠেন। প্রবল গণবিক্ষোভের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতেও বিক্ষোভের আঁচ লাগে।
শ্রীলঙ্কার সেই অর্থনৈতিক সঙ্কট এখনও পুরোপুরি কাটেনি। গত ফেব্রুয়ারিতেও দেশের নানা প্রান্তে দিনে ১৪০ মিনিট করে লোডশেডিং হয়েছে। বিদ্যুতের খরচ বেড়ে গিয়েছিল প্রায় ২৭৫ শতাংশ।
পড়শি দেশের এই বিপদের দিনে দেবদূতের মতো পাশে দাঁড়িয়েছে ভারত। মোটা অঙ্কের অর্থসাহায্য গিয়েছে দিল্লি থেকে কলম্বোতে। ভারতের প্রতি তাই ‘চিরকৃতজ্ঞ’ শ্রীলঙ্কা।
সম্প্রতি ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছে শ্রীলঙ্কা। ভারতে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রদূত মিলিন্দা মোরাগোডা সংবাদমাধ্যম ‘দ্য প্রিন্ট’কে জানিয়েছেন, ভারতের কারণেই আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডারের (আইএমএফ) সাহায্য পেয়েছে তাঁর দেশ।
মিলিন্দা জানিয়েছেন, গত বছর অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময় শ্রীলঙ্কার পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারত। মোট ৪০০ কোটি ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা) অর্থসাহায্য গিয়েছিল দিল্লি থেকে।
শুধু তা-ই নয়, রাষ্ট্রপুঞ্জেও শ্রীলঙ্কার পাশে দাঁড়ায় ভারত। তাঁদের সুপারিশেই শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দিতে রাজি হয় আইএমএফ। যে কারণে দেশটি প্রবল সঙ্কটের মাঝেও ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে।
শ্রীলঙ্কার বিদেশমন্ত্রী আলি সাবরিও ভারতের ঢালাও প্রশংসা করেছেন। তাঁর মতে, শ্রীলঙ্কার সঙ্কটের দিনে অনেক মিত্র দেশই পাশে দাঁড়িয়েছিল। তবে ভারতের মতো সাহায্য আর কেউ করেনি।
আইএমএফ থেকে ২৯০ কোটি ডলারের ঋণ পেয়েছে শ্রীলঙ্কা। যা তাদের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করেছে। এই ঋণের জন্য ভারতই সুপারিশ করে রাষ্ট্রপুঞ্জে।
শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দেওয়ার জন্য আইএমএফকে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা দিয়েছিল ভারত, স্বীকার করেন সে দেশের বিদেশমন্ত্রী। ভারতই প্রথম ধুঁকতে থাকা দেশটির পাশে দাঁড়িয়েছিল। শ্রীলঙ্কার বিদেশমন্ত্রী বলেন, ভারতের এই ঋণ কখনও ভুলতে পারবেন না তাঁরা।
২০২২ সালের এপ্রিল মাসে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সঙ্কট প্রবল আকার ধারণ করে। দেশে সঞ্চিত বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছিল। ফলে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বৈদেশিক বাণিজ্য।
চারদিকে সমুদ্রে ঘেরা দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। দেশের ভূপ্রকৃতির দিকে চোখ রাখলে দেখা যায়, মধ্যবর্তী অংশে রয়েছে পাহাড়। ভূপ্রকৃতিগত কারণে শ্রীলঙ্কায় কৃষি তেমন উন্নত নয়।
খাদ্যশস্য বিদেশ থেকেই আমদানি করতে হয় শ্রীলঙ্কাকে। বৈদেশিক মুদ্রা ফুরিয়ে যাওয়ায় সেই আমদানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফলে সাধারণ মানুষকে না খেতে পেয়ে মরতে হচ্ছিল।
১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হয়েছিল শ্রীলঙ্কা। তার পর থেকে এমন চরম অর্থনৈতিক সঙ্কট কখনও দেখতে হয়নি দ্বীপরাষ্ট্রটিকে।
মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি বিদ্যুৎ সঙ্কটও চরমে পৌঁছেছিল। গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ, জ্বালানির মতো সাধারণ জিনিস জোগাড় করতে কালঘাম ছুটছিল আমজনতার।
এই পরিস্থিতি থেকে এখন কিছুটা হলেও মাথা তুলতে পেরেছে শ্রীলঙ্কা। ধীরে ধীরে দেশটি আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তার নেপথ্যে ভারতের কৃতিত্ব অনেকটাই।
শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে তাঁর দেশের ঋণের পরিমাণ তিন হাজার কোটি ডলার। তার মধ্যে শুধু চিনকেই দিতে হবে ৫৭০ কোটি ডলার। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সঙ্কটের জন্য চিনকেও দায়ী করেন কেউ কেউ।
কোভিড অতিমারির ধাক্কায় শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির মাজা ভেঙে গিয়েছিল, মেনে নিয়েছেন রাষ্ট্রদূত। ভারতের সঙ্গে আগামী দিনে দীর্ঘমেয়াদি সুসম্পর্ক এবং আরও বেশি বাণিজ্যিক আদানপ্রদানের ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন তিনি।