পেট্রল, ডিজেল হোক বা কয়লা। চিরাচরিত এই জ্বালানিগুলির ব্যবহার যত বাড়ছে, দিন দিন তার জোগানও তত কমছে। প্রকৃতিতে সঞ্চিত ভান্ডার ফুরিয়ে এলে এই জ্বালানির অভাবে হাহাকার করতে হবে পৃথিবীকে।
চিরাচরিত শক্তিগুলির এই সীমাবদ্ধতার কারণে আগে থেকেই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন বিকল্পের সন্ধান করা। ইতিমধ্যে যে কাজ শুরু করে দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
প্রকৃতির ভান্ডারে যে উপাদান অফুরন্ত, তা দিয়ে তৈরি জ্বালানি (হাইড্রোজেন জ্বালানি, সৌর জ্বালানি) অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য। যদিও তাদের জনপ্রিয়তা বা ব্যবহার, কোনওটাই তেমন নয়।
খনিজ তেল, কয়লার মতো চিরাচরিত শক্তি থেকে তৈরি জ্বালানিগুলির আরও একটি সীমাবদ্ধতা হল দূষণ। এই জ্বালানির ব্যবহারের ফলে এত বেশি দূষণ হয় যে, বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য এদের দায়ী করেন বিজ্ঞানীরা।
চিরাচরিত জ্বালানির এই সকল সীমাবদ্ধতার উপযুক্ত বিকল্প নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে অনেক দিন ধরেই। কার্যক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে আফ্রিকা মহাদেশের এক দেশ।
প্রচলিত জ্বালানিগুলির বিকল্প হিসাবে পরিবেশবান্ধব নতুন এক জ্বালানি তৈরির কাজে মন দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। বিপুল খরচ করে তারা ‘ভবিষ্যতের জ্বালানি’ তৈরি করবে বলে দাবি।
নতুন জ্বালানি তৈরির জন্য ইতিমধ্যে বড়সড় প্রকল্পের ঘোষণা করে দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার। গোটা প্রকল্পটিতে প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে চলেছে তারা।
দক্ষিণ আফ্রিকার দাবি, এমন এক অভিনব জ্বালানি তৈরি করা হবে, যা একই সঙ্গে হবে পরিবেশবান্ধব এবং স্থায়ী। এই জ্বালানির ব্যবহারে পরিবেশ এবং মানুষ, উভয়েরই সুবিধা হবে।
আন্তর্জাতিক জ্বালানির বাজারে গুরুত্ব বৃদ্ধি করতে চাইছে দক্ষিণ আফ্রিকা। তাদের প্রচেষ্টা সফল হলে নিঃসন্দেহে বাজারে তার দর বাড়বে। সেই সঙ্গে নতুন এক বিকল্প পাবে বিশ্ব।
নতুন জ্বালানি তৈরির প্রকল্প দক্ষিণ আফ্রিকাকে অন্য দিক থেকেও লাভবান করবে। এর ফলে দেশে কর্মসংস্থান তৈরি হবে, বেকারত্ব ঘুচবে। সার্বিক ভাবে দেশের অর্থনীতির পক্ষে এটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হতে চলেছে।
কী দিয়ে নতুন জ্বালানি তৈরির উদ্যোগ শুরু করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা? এ ক্ষেত্রে তাদের তুরুপের তাস কিন্তু আমাদের চেনা একটি যৌগ পদার্থ। যার নাম অ্যামোনিয়া।
দক্ষিণ আফ্রিকার ইস্টার্ন কেপ প্রদেশে হাজার হাজার হেক্টর জমি একদিন হয়ে উঠতে পারে পৃথিবীর বৃহত্তম পরিবেশবান্ধব অ্যামোনিয়া প্ল্যান্ট। পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি কাজে লাগিয়ে অ্যামোনিয়াকে পরিবেশবান্ধব করে তোলা সম্ভব।
এই অ্যামোনিয়াকেই জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করার কথা ভাবছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এতে জ্বালানির বাজারে কার্বনের প্রয়োগ কমবে। কমে আসবে দূষণের মাত্রাও।
দক্ষিণ আফ্রিকার ‘হাইভ এনার্জি আফ্রিকা’ নামের একটি সংস্থা সমগ্র প্রকল্পটি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে। সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর কলিন লৌবসের জানিয়েছেন, বিশেষত সমুদ্রপথে পরিবহণের জ্বালানি হিসাবে যোগ্য বিকল্প হয়ে উঠতে চলেছে পরিবেশবান্ধব অ্যামোনিয়া।
অ্যামোনিয়া জ্বালানি তৈরির প্রক্রিয়াটিও পরিবেশবান্ধব বলে দাবি সংস্থার। এই প্রক্রিয়ায় কেবল জল, বাতাস এবং শক্তি প্রয়োজন। হাইড্রোজেন এবং নাইট্রোজেনের সংযোগে অ্যামোনিয়া গঠিত হয়। জল থেকে হাইড্রোজেন এবং বাতাস থেকে সেই নাইট্রোজেন সংগ্রহ করা হবে।
২০২৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় এই নতুন প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। নিকটবর্তী একটি সৌরশক্তির কারখানা থেকে সব রকম সহায়তা গ্রহণ করা হবে। জলের জোগান দেবে স্থানীয় একটি সংস্থা, যেখানে সমুদ্রের জল থেকে লবণ আলাদা করা হয়।
তবে দক্ষিণ আফ্রিকার এই উদ্যোগেও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অ্যামোনিয়া একটি দুর্গন্ধযুক্ত বিষাক্ত গ্যাস। তাই বিশেষ পারদর্শিতা ছাড়া এই গ্যাস সামলানো কঠিন।
অ্যামোনিয়া জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা হলে নাইট্রোজেন অক্সাইড গ্যাস নির্গত হয়। এটি গ্রিন হাউস গ্যাস। বায়ুদূষণের জন্য বিশেষ ভাবে দায়ী। তাই দূষণ এড়িয়ে কী ভাবে অ্যামোনিয়া জ্বালানি প্রস্তুত করা যায়, তা দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে।