পৃথিবীতে মানবসভ্যতার জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ থেকে ৩০০০ অব্দে। প্রথম দিকে পশুর আদলেই ছিল মানুষের গড়ন। ধীরে ধীরে তাতে লেগেছে বুদ্ধি আর অগ্রগতির ছাপ। বনবাসী মানুষ ক্রমে হয়েছে গৃহবাসী।
সভ্যতা যত এগিয়েছে ভবিষ্যতের পাশাপাশি অতীত নিয়েও ঘেঁটেছে মানুষ। গবেষণার মাধ্যমে তারা জানতে পেরেছে সৃষ্টির আদিলগ্নের কথা। তাদের অতীত পরিচয়। তবে ইতিহাসের গর্ভে যে সময় হারিয়ে গিয়েছে, আজও তা রহস্য হয়ে থেকে গিয়েছে।
তেমনই এক অতীত রহস্যের নাম ভ্রাবেল। অধুনা ইউরোপ মহাদেশের মধ্যভাগে অবস্থিত স্লোভাকিয়া দেশের ছোট্ট শহর ভ্রাবেল। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সুদূর অতীতের প্রস্তর যুগের এক রহস্য।
স্লোভাকিয়ার ভ্রাবেল শহরের খুব কাছে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা একটি প্রাচীন গ্রামের সন্ধান পেয়েছেন। হিসাব করে দেখা গিয়েছে, গ্রামটি গড়ে উঠেছিল আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। পৃথিবীর বুকে তখনও চলছে প্রস্তর যুগ।
প্রস্তর যুগের মানুষের প্রাথমিক বাসস্থান ছিল নদীর ধার, বনজঙ্গল কিংবা পাহাড়ের গুহা। এই যুগের শেষের দিকে মানুষ মাথার উপর ছাদ তৈরি করতে শিখেছিল। হাতের কাছে পাওয়া উপকরণ দিয়ে তৈরি করেছিল কুটির।
প্রাচীনকালের এমন অনেক গ্রামের সন্ধান মিলেছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে, মানবসভ্যতার ক্রম অগ্রগতির ছাপ যেখানে স্পষ্ট। কিন্তু স্লোভাকিয়ার গ্রামটির বিশেষত্ব কী? কেন তাকে নিয়ে এত আলোচনা?
স্লোভাকিয়ায় আবিষ্কৃত প্রাচীন গ্রামটি দেখে প্রত্নতত্ত্ববিদেরাও বিস্মিত হয়েছিলেন। কারণ গ্রামটি ‘ঘূর্ণায়মান’। খালি চোখে দেখে যে কেউ এই বক্তব্য মেনে নিতে বাধ্য হবেন।
গ্রামের আকৃতি, ঘরবাড়িগুলির দিকে তাকালে মনে হয়, গ্রামটি যেন ঘুরে চলেছে। ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে গ্রামের বাড়িগুলি যেন ঘুরছে। সরে যাচ্ছে আগের অবস্থান থেকে।
গ্রাম তো জীবন্ত নয়, যে ঘুরবে! সত্যি সত্যি তা ঘুরছেও না। তবে শুকনো, শক্ত মাটির উপর তৈরি বাড়িঘর কেন ঘুরছে বলে মনে হয়? এর নেপথ্যে কোন রহস্য লুকিয়ে আছে?
স্লোভাকিয়ার ভ্রাবেল নিয়ে দীর্ঘ দিন বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন। গ্রামটির এমন গড়নের কারণ কী, কেন তাকে ঘূর্ণায়মান বলে মনে হয়, তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। উঠে এসেছে একাধিক তত্ত্ব।
গবেষকেরা লক্ষ্য করেন, গ্রামের বাড়িগুলির মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রতিটি বাড়িই একটু করে বাঁ দিকে ঘেঁষা। সে ভাবেই নির্মাণ করা হয়েছে বাড়িগুলি। প্রতিটি বাড়ির গড়নও একরকম। নতুনত্ব নেই।
প্রথম বাড়ির পর দ্বিতীয় যে বাড়ি গড়ে তোলা হয়েছিল, সেটি আগেরটার সঙ্গে সমান্তরাল নয়। বরং একটু বাঁ দিক ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছিল। ঠিক তেমনই তৃতীয় বাড়ি আবার দ্বিতীয় বাড়ির থেকেও একটু বাঁ দিক ঘেঁষা। এ ভাবেই গ্রামের সমস্ত বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল।
বাড়িগুলি একসঙ্গে তৈরি করা হয়নি। প্রতিটি বাড়ির নির্মাণের মাঝে ছিল আনুমানিক ৩০ থেকে ৪০ বছরের ব্যবধান। গোটা গ্রামটি গড়ে উঠতে প্রায় ৩০০ বছর সময় লেগেছিল বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
বাঁ দিক ঘেঁষে বাড়ি তৈরির কারণেই সমগ্র গ্রামটিকে দূর থেকে দেখলে তা ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ‘ঘূর্ণায়মান’ বলে মনে হয়। এখন প্রশ্ন, কেন এ ভাবে গ্রামটি গড়ে উঠেছিল?
এ ক্ষেত্রেও নানা কারণ উঠে এসেছে। বিজ্ঞানীরা নানা ভাবে বাঁ দিক ঘেঁষে বাড়ি তৈরিকে ব্যাখ্যা করেছেন। গবেষকদের একাংশের অনুমান, ডান দিক দিয়ে জোরে বয়ে আসা হাওয়ার গতি থেকে বাঁচতেই এ ভাবে সামান্য বাঁ দিক ঘেঁষে বানানো হয়েছিল ভ্রাবেলের বাড়িগুলি।
অনেকে আবার বলেন, সূর্যের আলো যাতে আড়াল না হয়, তা নিশ্চিত করতেই বাড়িগুলি সমান্তরালে না বানিয়ে এক দিকে সরিয়ে বানানো হয়েছিল।
নানা তত্ত্বের ভিড়ে যে কারণটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে, সেটি মনস্তাত্ত্বিক। বিজ্ঞানীদের একাংশ বলেন, দেখা এবং শোনার ক্ষেত্রে মানুষ বরাবরই বাঁ দিকে মনোযোগ বেশি দেয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানেও যার ব্যাখ্যা রয়েছে।
কোনও লাইনের মধ্যভাগটি চিহ্নিত করতে দিলে, বেশির ভাগ মানুষ যে বিন্দু নির্দিষ্ট করেন, সেটি আসলে মধ্যভাগে থাকে না। সামান্য বাঁ দিক ঘেঁষে থাকে। বিজ্ঞান একে বলে ‘সিউডোনেগলেক্ট’।
ভ্রাবেলের গ্রামের বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে মানুষের সেই সহজাত বাঁ দিক ঘেঁষার প্রবণতাকে দায়ী করা হয়। প্রস্তর যুগের মানুষ যখন একই এলাকায় একটির পর একটি বাড়ি তৈরি করে চলেছেন, তাঁরা খালি চোখে দিক ঠিক রাখতে পারেননি।
তাঁরা যে বাড়িগুলি বাঁ দিক ঘেঁষে বানাচ্ছেন, সে বিষয়েও তৎকালীন মানুষের কোনও ধারণা ছিল না। পরে প্রযুক্তির মাধ্যমে এই রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে।