দিল্লিতে শ্রদ্ধা ওয়ালকর খুনের ঘটনা সাড়া ফেলে দিয়েছে। প্রেমিকাকে খুন করে তাঁর দেহ টুকরো টুকরো করে কেটেছেন প্রেমিক তথা লিভ ইন সঙ্গী আফতাব আমিন পুনাওয়ালা। দেহাংশ প্যাকেটে মুড়ে ফ্রিজে রেখে দিয়েছিলেন তিনি। ৬ মাস আগের এই খুনের কথা প্রকাশ্যে আসার পর কার্যত শিউরে উঠেছে গোটা দেশ।
কে এই শ্রদ্ধা ওয়ালকর? জানা গিয়েছে ২৮ বছর বয়সি তরুণী মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা। পালঘর জেলায় তাঁর বাড়ি। কর্মসূত্রে থাকতেন মুম্বইয়ে।
মুম্বইতে একটি কল সেন্টারে কাজ করতেন শ্রদ্ধা। সেখানে কাজ করতে করতে নাকি আফতাবের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছিল। আলাপ হয় একটি ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে। এমনটাই দাবি করেছেন শ্রদ্ধার বাবা বিকাশ মদন।
আফতাবও কল সেন্টারে কাজ করতেন। তিনি পেশাগত ভাবে ফুড ব্লগার ছিলেন বলে খবর। খাবারের ভিডিয়ো তৈরির পাশাপাশি দিল্লির কল সেন্টারে চাকরিও করতেন।
শ্রদ্ধার বাবা বিকাশ জানিয়েছেন, কল সেন্টারে কাজ করতে করতে আফতাবের সঙ্গে তাঁর মেয়ের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল। পরিবারের কারও এই সম্পর্কে সায় ছিল না।
পরিবারের বাধা পেয়ে ঘর ছেড়েছিলেন শ্রদ্ধা। তিনি আফতাবের সঙ্গে লিভ ইন সম্পর্কে থাকবেন বলে মুম্বই থেকে দিল্লি চলে এসেছিলেন। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে তাঁরা দিল্লির বাড়িতে থাকতে শুরু করেছিলেন।
দক্ষিণ দিল্লির ছতরপুর এলাকায় একটি নতুন ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলেন আফতাব এবং শ্রদ্ধা। ৯৩/১ ছতরপুরের সেই বাড়িতে প্রেমিকের সঙ্গে নতুন করে জীবন শুরু করতে চেয়েছিলেন শ্রদ্ধা।
যা ভেবেছিলেন, তা হয়নি। নতুন ফ্ল্যাটে এক মাসের বেশি টিকতে পারেননি শ্রদ্ধা। প্রেমিকের সঙ্গে তাঁর নিত্য অশান্তি লেগে থাকত। সম্পর্কের চরম পরিণতি হয় মে মাসে।
১৮ মে ফ্ল্যাটে প্রেমিকের হাতে খুন হন শ্রদ্ধা। তাঁকে প্রথমে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়। পরে সেই দেহ টুকরো টুকরো করে কাটেন আফতাব।
আমেরিকার জনপ্রিয় একটি ওয়েবসিরিজ় ‘ডেক্সটার’ দেখে এই খুনের পরিকল্পনা করেছিলেন, পুলিশকে জানিয়েছেন আফতাব। কিছু দিন ধরে পরিকল্পনা করার পর তা বাস্তবায়িত হয় মে মাসের ১৮ তারিখ।
পুলিশ জানতে পেরেছে, নতুন ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করার পর শ্রদ্ধা সংসার পাততে চেয়েছিলেন। তাঁর সেই ইচ্ছাই কাল হয়ে দাঁড়ায়। বিয়ে করতে একেবারেই উৎসাহী ছিলেন না আফতাব।
পুলিশকে আফতাব জানিয়েছেন, শ্রদ্ধা তাঁকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি লিভ ইন সম্পর্কেই থাকতে চেয়েছিলেন। তাই ‘নাছোড়বান্দা’ প্রেমিকাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন আফতাব।
শ্রদ্ধার মৃত্যুর কথা প্রকাশ্যে আসার পর তাঁর বাবা ‘লভ জিহাদ’-এর অভিযোগ তুলেছেন। সংবাদমাধ্যমে তিনি বলেছেন, ‘‘এই ঘটনায় একটি লভ জিহাদের বিষয় রয়েছে বলে আমার মনে হয়। আমি আফতাবের মৃত্যুদণ্ড দাবি করছি। দিল্লি পুলিশ সঠিক পথে তদন্ত করছে। আমি দিল্লি পুলিশের কাজের উপর আস্থা রাখছি।’’
শ্রদ্ধা বাবার চেয়েও কাকার সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন, জানিয়েছেন তাঁর বাবা বিকাশ। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর মেয়ে এমনিতে বেশ চুপচাপ। বেশি কথা কোনও সময়েই বলতেন না। আফতাবের সঙ্গে শ্রদ্ধার বাবার কখনও কথা হয়নি।
তদন্তের মাধ্যমে পুলিশ জানতে পেরেছে, দিল্লিতে চলে আসার আগে মহারাষ্ট্রে বেশ কয়েক মাস এক সঙ্গে কাটিয়েছিলেন আফতাব এবং শ্রদ্ধা। ২০১৯ সাল থেকে তাঁদের এই সম্পর্ক। এমনকি প্রেমিকের সঙ্গে হিমাচল প্রদেশে এক বার ঘুরতেও গিয়েছিলেন শ্রদ্ধা।
তদন্তের মাধ্যমে পুলিশ জানতে পেরেছে, দিল্লিতে চলে আসার আগে মহারাষ্ট্রে বেশ কয়েক মাস এক সঙ্গে কাটিয়েছিলেন আফতাব এবং শ্রদ্ধা। ২০১৯ সাল থেকে তাঁদের এই সম্পর্ক। এমনকি প্রেমিকের সঙ্গে হিমাচল প্রদেশে এক বার ঘুরতেও গিয়েছিলেন শ্রদ্ধা।
নতুন ফ্ল্যাটে আসার কিছু দিনের মধ্যেই শ্রদ্ধা খুন হন। পুলিশ তদন্ত করে দেখছে, আফতাব আগে থেকেই এই খুনের পরিকল্পনা করেছিলেন কি না। পুলিশের সন্দেহ, খুন করার জন্যই নতুন ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলেন আফতাব।
মেয়ে অন্যত্র চলে গেলেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন শ্রদ্ধার বাবা-মা। কিন্তু বিকাশ দাবি করেছেন, মে মাসের পর থেকে আর মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। অবশেষে ৮ নভেম্বর মুম্বইতে অপহরণের লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন বিকাশ।
লভ জিহাদের অভিযোগ তুলে বিকাশের দাবি, প্রেমের ফাঁদে ফেলে শ্রদ্ধার ধর্ম পরিবর্তন করার পরিকল্পনা ছিল আফতাবের। তাই শ্রদ্ধাকে তিনি দিল্লি নিয়ে গিয়েছিলেন। আফতাবের ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন তিনি।
শ্রদ্ধাকে খুনের পর দেহ টুকরো টুকরো করে কেটেছিলেন আফতাব। মোট ৩৫টি টুকরো করা হয় শ্রদ্ধার দেহের। খুনের পর ৩০০ লিটারের একটি নতুন ফ্রিজ কিনে এনেছিলেন আফতাব। শ্রদ্ধার দেহের টুকরোগুলিকে প্যাকেটে ভাল করে মুড়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন ফ্রিজে।
প্রতি দিন রাত ২টো বাজলেই ফ্রিজ খুলতেন আফতাব। প্রেমিকার দেহের টুকরো একটি একটি করে তুলে নিতেন। তার পর নিকটবর্তী জঙ্গলে গিয়ে টুকরোগুলি ছড়িয়ে দিয়ে আসতেন, প্রতি দিন একটি করে।
শ্রদ্ধাকে খুনের পর গুগ্লে আফতাব সার্চ করেছিলেন, কী ভাবে রক্ত পরিষ্কার করতে হয়। অ্যানাটমি বা শরীরতত্ত্ববিদ্যা নিয়েও ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলেন তিনি।
শ্রদ্ধাকে খুনের পর একটি অনলাইন ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে আফতাব অন্য মেয়েদের সঙ্গে মিশতেন। মেয়েদের বাড়িতেও ডাকতেন। পুলিশের কাছে তিনি স্বীকার করেছেন, যে বাড়িতে শ্রদ্ধার দেহের টুকরো রাখা ছিল, সেখানেই তিনি একাধিক মহিলা সঙ্গীর সঙ্গে মেতেছিলেন উদ্দাম যৌনতায়।
শ্রদ্ধার খুনের পর আফতাবের বাড়িতে অনেকেই আসতেন। কিন্তু কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পাননি ঘরের কোনায় রাখা ফ্রিজে রয়েছে তাঁর প্রেমিকার দেহের টুকরো।
তদন্ত যত এগিয়েছে, একাধিক চাঞ্চল্যকর তথ্য এসেছে পুলিশের হাতে। প্রশ্ন উঠেছে আফতাবের মানসিক স্থিতি নিয়েও। মনোবিজ্ঞানীদের একাংশের মতে, আফতাব সাইকোপ্যাথ। আগেও এমন খুন তিনি করে থাকতে পারেন।
আফতাব-শ্রদ্ধার ফ্ল্যাট থেকে প্রায়শই মারপিট, বাগ্বিতণ্ডা এবং তর্কাতর্কির আওয়াজ শোনা যেত! প্রায়ই নাকি শ্রদ্ধার উপর ‘পাশবিক অত্যাচার’ও করতেন অভিযুক্ত প্রেমিক আফতাব। পুলিশ সূত্রে এমনই খবর।
দিল্লির মেহরৌলি হত্যাকাণ্ড নিয়ে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ্যে আনলেন আফতাব-শ্রদ্ধার প্রতিবেশী। নিহত শ্রদ্ধা এবং অভিযুক্ত আফতাব যে ফ্ল্যাটটিতে ভাড়া থাকতেন, তার পাশের ফ্ল্যাটে থাকা প্রতিবেশীর দাবি, প্রায়ই তিনি তাঁদের বাড়ি থেকে গার্হস্থ্য হিংসার আওয়াজ শুনতে পেতেন।
এক সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওই প্রতিবেশী মহিলা বলেন, ‘‘কয়েক বার আমার মেয়ে আফতাব এবং শ্রদ্ধার চিৎকার শুনেছিল। কয়েক বার আমার শাশুড়িও ওদের চিৎকার করতে শুনেছিল।’’
তবে যে দিন শ্রদ্ধাকে খুন করা হয়েছিল, সেই দিন তাঁরা সন্দেহজনক কিছু দেখেননি বা শোনেননি বলেও ওই প্রতিবেশী জানিয়েছেন।