প্রায় সাড়ে ন’কোটি মাইল দূরের সূর্য থেকে ছুটে এসে পৃথিবীর উপর হামলা চালায় ভয়ঙ্কর শক্তিশালী হানাদারেরা। সৌরপদার্থবিজ্ঞানের পরিভাষায় এই হানাদারদের নাম ‘সৌরঝলক’ (‘সোলার ফ্লেয়ার’)। এর মাধ্যমে সূর্যের অন্দর থেকে বিপুল পরিমাণে শক্তি বেরিয়ে আসে, ছড়িয়ে পড়ে মহাকাশে।
প্রলয়ঙ্কর বিস্ফোরণের পর সূর্যের শরীর থেকে বেরিয়ে আসে অত্যন্ত বিপজ্জনক ও শক্তিশালী প্রচুর কণা। আমরা যাকে সৌরঝড় বলে জানি, তার অন্যতম কারণ এই সৌরঝলক।
সূর্য থেকে প্রতি দিনই একটি বা দু’টি ঝোড়ো আগুনের ঝাপটা ছিটকে আসে পৃথিবী ও পড়শি গ্রহের দিকে। সেই সৌরঝড়ের প্রভাব পড়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলেও। বিজ্ঞানীদের হিসাব বলছে, এ ঝড়ের তীব্রতা আরও বাড়বে চলতি বছর।
এর কারণ কী? সৌরচক্রের সবচেয়ে কঠিন সময়টি প্রায় আগত। ২০২৫ সালে ‘সোলার ম্যাক্সিমাম’ পর্বে পা রাখবে সূর্য। ২০২৪ থেকেই ঝড়ের প্রকোপ টের পাওয়া গিয়েছে কয়েক দফায়।
বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, ঝড়ের দাপটে ভাল মতো ভুগতে হবে সৌরপরিবারের অধিবাসী পৃথিবীকে। আচমকা সূর্যের বুকে বিস্ফোরণ এবং তার পরে আয়নিত কণার স্রোত, প্রবল শক্তি-সহ ছড়িয়ে পড়ে সৌরসংসারে।
পৃথিবীর চৌম্বকশক্তির আচ্ছাদন আমাদের এই হানাদারকে প্রায় হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়। পৃথিবীর কাছাকাছি এলে উত্তর মেরুতে থাকা শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র তাকে দূরে হটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আর তখনই চৌম্বকক্ষেত্রের কণাদের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে উত্তর মেরুতে শক্তিশালী উজ্জ্বল মেরুজ্যোতি তৈরি হয়।
জন্মকাল থেকে প্রতিনিয়ত সৌর হানাদারদের হামলা ঠেকিয়ে আসছে পৃথিবী। প্রতি বছরই অতর্কিতে হানা দিয়ে পৃথিবীর যোগাযোগ ব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দিয়ে চলে যায় তারা। আবার কখনও বা ঘন ঘন উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখা যায় মেরুজ্যোতিকে।
২০২৫ সালে এই সৌরশিখা বা সৌরঝলক নিয়ে আশঙ্কার কথাই শুনিয়েছেন নাসার বিজ্ঞানীরা। সূর্যের পিঠে আচমকাই হয় সৌরঝলক। চলতি বছরে যে হানাদারের দল পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে তার শক্তির তীব্রতা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন নাসার জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।
‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজ়িক্স’-এর ডিরেক্টর অন্নপূর্ণি সুব্রহ্মণ্যন সংবাদমাধ্যমে গত বছর বলেন, ‘‘মে মাসে একটা সৌরঝড় হয়েছিল। কয়েক দিন আগে সৌরশিখার যে তীব্রতা দেখা গিয়েছে, তা শক্তিতে গত বারের ওই সৌরঝড়ের সমতূল্য।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘আমাদের আশঙ্কা, ম্যাগনেটোস্ফিয়ারে এর প্রভাব পড়বে। আমরা অপেক্ষা করে দেখতে চাই। সূর্য থেকে পৃথিবীতে ওই সৌরঝড় পৌঁছতে কয়েক দিন সময় লাগে।’
কিন্তু পৃথিবীবাসীর জীবনে কি এর প্রভাব পড়বে? বিজ্ঞানী ও গবেষকেরাও দোলাচলে রয়েছেন। তাঁদের মতে, খারাপ কিছু ঘটলেও ঘটতে পারে। আবার কিছু না-ও হতে পারে। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
আয়নিত কণার স্রোত প্রবল শক্তি-সহ ছড়িয়ে পড়ে সৌরসংসারে। এর জেরে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। চার্জড পার্টিকল বা আয়নিত কণার ঝড়ের মুখে পড়ে পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরতে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহগুলি। সৌরশিখার প্রবল শক্তির মুখে পড়ে সেই সব অগণিত উপগ্রহ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে।
মহাকাশ বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, সে রকম ভয়ঙ্কর কিছু হলে সেই তাণ্ডবে সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়তে পারে ইন্টারনেট পরিষেবা। সৌরশিখার দাপট বেশি হলে প্রভাব পড়তে পারে ডিজিটাল দুনিয়া ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থায়।
উপগ্রহগুলি ভেঙে গিয়ে নিজের কক্ষপথ ছেড়ে প্রচণ্ড গতিতে ধেয়ে আসতে পারে পৃথিবীর দিকে। সেগুলি পৃথিবীতে আছড়ে পড়লে বড় ক্ষতি হতে পারে।
ইতিমধ্যেই সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে ‘বিপদবার্তা’। ভুয়ো খবর যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, তার জন্য বিশ্ববাসীকে সতর্ক করেছে নাসার গবেষকেরা। গুজব আটকানোয় জোর দিয়েছে সংস্থাটি।
একটি আমেরিকান সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে ১৮৫৯ সালের পুরনো একটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। তার নাম ‘ক্যারিংটন ইভেন্ট’। সে বার টেলিগ্রাফের তারে আগুন ধরে গিয়েছিল। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান অনেকে। সৌরঝড়ের জেরে দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছিল বিস্তীর্ণ এলাকা।
কী ভাবে ক্ষতি হতে পারে পৃথিবীর? ধেয়ে আসা সেই সৌরঝলক পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের অনেকটা উপরের আয়নোস্ফিয়ারে ব্যাপক ঝঞ্ঝার সৃষ্টি করে। সেই স্তরে থাকা প্রচুর পরিমাণ কণাকে আয়নে পরিণত করে।
তার ফলে, ভূপৃষ্ঠের উপর ৬০ থেকে ১০০ কিলোমিটার উচ্চতায় খুব শক্তিশালী বিদ্যুৎপ্রবাহের জন্ম হয়। সেই বিদ্যুৎপ্রবাহ ভূপৃষ্ঠেও পৌঁছয়। তার জেরে পৃথিবীর দুই মেরুর চৌম্বকক্ষেত্রের পরিবর্তন ঘটে।
বিশেষজ্ঞদের প্রবল আশঙ্কা, এর ফলে কিছু ক্ষণের জন্য হলেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ মেরু, উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও উত্তর মেরুর যাবতীয় রেডিয়ো যোগাযোগ ব্যবস্থা। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বিশ্বের একাংশের বিদ্যুৎসংযোগ ব্যবস্থাও।
ক্ষয়ক্ষতির ধাক্কা সইতে হতে পারে পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহগুলির অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশগুলিকেও। এর ফলে ব্যাঘাত ঘটতে পারে উপগ্রহের মাধ্যমে জিপিএস ব্যবস্থা, ভূপর্যবেক্ষণ, এমনকি মোবাইল যোগাযোগ ব্যবস্থাও।