শ্রদ্ধা ওয়ালকর হত্যাকাণ্ড নিয়ে জটিলতা কমছে না। কারণ এখনও পর্যন্ত পুলিশের হাতে এমন কোনও প্রমাণ উঠে আসেনি, যার ভিত্তিতে বলা যায় শ্রদ্ধা খুন হয়েছেন। আইনের চোখে এখনও তিনি ‘নিখোঁজ’।
দিল্লি পুলিশের দাবি, জেরায় আফতাব স্বীকার করেছেন যে তিনি শ্রদ্ধাকে খুন করেছেন। এমনকি মঙ্গলবার আদালতকেও আফতাব জানিয়েছেন, হঠাৎ রাগের বশে তিনি মেরে ফেলেছিলেন শ্রদ্ধাকে। অথচ ওই দিনই আফতাবের আইনজীবীর দাবি, তাঁর মক্কেল আদৌ খুনের কথা স্বীকার করেননি।
আইনের চোখে কাউকে মৃত প্রমাণ করতে হলে তাঁর দেহ পাওয়াটা জরুরি। একই সঙ্গে, কেউ খুন হয়েছেন প্রমাণ করতে হলে, খুনের হাতিয়ার উদ্ধার হওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
মেহরৌলীর যে জঙ্গলে শ্রদ্ধার মৃতদেহের টুকরোগুলি আফতাব ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ, সেই জঙ্গলে তল্লাশি চালিয়ে শরীরের বড় কোনও টুকরো এখনও খুঁজে পায়নি দিল্লির পুলিশ।
জঙ্গল থেকে মৃতদেহের যে অংশগুলি পাওয়া গিয়েছে তার মধ্যে ছিল চোয়াল এবং কব্জির কাটা অংশ। হাড়গোড়ের যে ছোট ছোট টুকরোগুলি পাওয়া গিয়েছে, তা ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। অর্থাৎ, এই দেহাংশগুলি শ্রদ্ধারই, তা এখনও প্রমাণসাপেক্ষ।
দিল্লির যে ফ্ল্যাটে শ্রদ্ধা এবং আফতাব একত্রবাস করতেন, সেই ফ্ল্যাটের রান্নাঘর এবং বাথরুমের টাইলস্ খুলে রক্তের চিহ্নও পেয়েছেন কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক পরীক্ষাগারের (সিএফসিএল) বিশেষজ্ঞেরা। তবে এই রক্ত শ্রদ্ধার, তা এখনও প্রমাণিত হয়নি।
রক্তের নমুনা পরীক্ষা করার জন্য ফরেন্সিক দল তৎপর হয়েছে। শ্রদ্ধার বাবা এবং ভাইয়ের ডিএনএ নমুনার সঙ্গে মিল পেলেই এগুলি তদন্তের সাপেক্ষে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ প্রমাণ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু ফরেন্সিক পরীক্ষার ফলাফল আসতে এখনও এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগতে পারে।
গত ১৮ মে দিল্লির ফ্ল্যাটে ২৭ বছর বয়সি শ্রদ্ধা খুন হন বলে অভিযোগ।শ্রদ্ধার সঙ্গে দীর্ঘ কাল ধরে সম্পর্কে ছিলেন আফতাব। দু’জনে একত্রবাসও করতেন।
অভিযোগ, শ্রদ্ধাকে খুন করে তাঁর দেহ ৩৫ টুকরো করেছিলেন আফতাব। দিল্লি পুলিশের দাবি, গুগ্ল করে মানবদেহ টুকরো করে কাটা এবং রক্তের দাগ পরিষ্কারের পদ্ধতি খুঁজেছিলেন ধৃত আফতাব। আমেরিকার ওয়েব সিরিজ় থেকে ‘অনুপ্রেরণা’ নিয়ে শ্রদ্ধার মৃতদেহের টুকরো সংরক্ষণ করার পরিকল্পনাও এঁটেছিলেন বলে পুলিশের দাবি।
ফ্ল্যাটে নতুন ফ্রিজ কিনে মৃতদেহের টুকরোগুলি তার ভিতর সংরক্ষিত করে রাখতেন আফতাব। তার পর সুযোগ বুঝে টুকরোগুলি দিল্লির মেহরৌলীর জঙ্গলে ছড়িয়ে দিতেন।
পুলিশ দিল্লির ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালিয়ে সেই ফ্রিজ উদ্ধার করলেও, প্রাথমিক ভাবে এমন কোনও অস্ত্র খুঁজে পায়নি যা দিয়ে খুন এবং খুনের পর দেহ টুকরো করা যেতে পারে। পরে অবশ্য করাত, ব্লেড, ছুরি-সহ নানা ধরনের হাতিয়ার খুঁজে পেয়েছেন তদন্তকারীরা।তবে সেই হাতিয়ারগুলিই খুন বা দেহ টুকরো করতে ব্যবহার করা হয়েছিল কি না, তা প্রমাণ হয়নি এখনও।
আফতাবের আইনজীবী অবিনাশ কুমারের মতে, দিল্লি পুলিশ শ্রদ্ধার খুনের মামলার যে তদন্ত করছে, তা পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ নির্ভর। আইনজীবীদের আরও অনেকেই মনে করছেন, আফতাব পুলিশকে যা তথ্য দিয়েছেন, তার উপর ভিত্তি করে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। কিন্তু, এখনও পুলিশের হাতে কোনও জোরদার প্রমাণ আসেনি যা দিয়ে প্রমাণ করা যায় যে আফতাব ‘খুনি’। কারণ শ্রদ্ধা খুন হয়েছেন, এই ‘প্রমাণ’ই পুলিশের হাতে নেই।
আফতাবের বিরুদ্ধে শ্রদ্ধার উপর অত্যাচারের বেশ কিছু অভিযোগ ইতিমধ্যেই পুলিশ পেয়েছে। পুলিশের দাবি, শ্রদ্ধা তাঁর কাছের বন্ধুবান্ধবদেরও জানিয়েছিলেন যে আফতাব নিয়মিত তাঁকে মারধর করতেন।
শ্রদ্ধা এবং আফতাব কাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, তা-ও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। দু’জনের সমাজমাধ্যমের অ্যাকাউন্টগুলি থেকে কাকে কী বার্তা পাঠানো হয়েছে, সে দিকেও পুলিশের নজর রয়েছে।
শ্রদ্ধার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে কবে কত পরিমাণ টাকা তোলা হয়েছে, তার সম্পূর্ণ বিবরণও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
দিল্লি পুলিশের ২০টি দল এই খুনের মামলায় তল্লাশি চালাচ্ছে। সূত্রের খবর, প্রায় ২০০ জন পুলিশকর্মী এই তদন্তের সঙ্গে রয়েছেন। তাঁদের সহায়তা করছেন ফরেন্সিক দলের বিশেষজ্ঞরা।
শুধু মাত্র আফতাবের দেওয়া তথ্যের উপর নির্ভর করে এই খুনের মামলা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে একাংশের দাবি। দিল্লি পুলিশের তদন্তে অসন্তোষ প্রকাশ করে সিবিআই তদন্ত চেয়ে জনস্বার্থ মামলা হয়েছিল দিল্লি হাই কোর্টে। সেই আবেদন অবশ্য খারিজ হয়ে গিয়েছে।
আদালতের তরফে জানানো হয়, অভিযুক্ত এখনও পর্যন্ত সব সঠিক তথ্য দিয়েছেন পুলিশকে। তদন্তও অনেক দূর এগিয়েছে, তাই দিল্লি পুলিশের হাতেই তদন্তভার থাকবে বলে জানিয়ে দিয়েছে দিল্লি হাই কোর্ট।
দিল্লি পুলিশের দাবি, তাদের তরফে তদন্ত প্রায় ৮০ শতাংশ সম্পূর্ণ। কিন্তু বাকিটা নির্ভর করে রয়েছে ফরেন্সিক পরীক্ষার ফলাফলের উপর।