বুলডোজ়ার নাকি ট্যাঙ্কার। আপাত ভাবে দেখে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিলেন না প্যাট্রিক ব্রাওয়ার্স। অদ্ভুত সেই যান ক্রমে ধেয়ে আসছিল তাঁর সংবাদপত্রের দফতরের দিকে। দফতরের ভিতরে বসে তিনি হতভম্ব হয়ে দেখছিলেন। সম্বিৎ ফেরে। বুঝতে পারেন, পালাতে হবে। কোনও মতে তিনি এবং তাঁর এক সহকর্মী দফতর ছেড়ে বেরিয়ে যান। আর একটু দেরি হলেই নিজেদের গল্পটা বলার সুযোগ পেতেন না প্যাট্রিক। হয়তো পিষে যেতেন ‘কিলডোজ়ার’-এর নীচে।
কী সেই ‘কিলডোজ়ার’ যা প্রায় ২০ বছর আগে ত্রাস জাগিয়েছিল কলোরাডো শহরে? ২ ঘণ্টা ৭ মিনিট ধরে চলেছিল ধ্বংসলীলা। সেই স্মৃতি আজও ভুলতে পারেননি আমেরিকার এই শহরের বাসিন্দারা।
বুলডোজ়ারের চালকের আসন মুড়ে ফেলা হয়েছে ইস্পাতের পাতে। সেখানে বসেই বুলডোজ়ার নিয়ে ধ্বংসের খেলায় নেমেছিলেন মারভিন হিমেয়ার। ‘বিদ্রোহ’ ঘোষণা করেছিলেন প্রশাসনের বিরুদ্ধে। সেই ‘বিদ্রোহে’ মারভিন ছাড়া যদিও আর কারও প্রাণ যায়নি।
নব্বইয়ের দশকে কলোরাডোতে ছোট একটা ঢালাইয়ের দোকান ছিল মারভিনের। গাড়ি, বাইকের সাইলেন্সার সারাতেন। ১৯৯২ সালে জমি কিনে নিজের একটি দোকান তৈরি করেন। তার আশপাশের জমি ফাঁকাই ছিল।
২০০১ সালে মারভিনের পাশের জমি বিক্রি করে দেয় পুরসভা। তাতেই চটে যান মারভিন। বাড়ি থেকে রোজ যে পথে দোকান আসতেন, সেই পথ বন্ধ হয়ে যায়। অনেক ঘুরে ঘুরে দোকানে আসতে হত মারভিনকে। সময়ও বেশি লাগত।
দোকান সংলগ্ন জমিতে নির্মাণ বন্ধের আবেদন জানান মারভিন। সেই আবেদন খারিজ হয় বার বার।
২০০৩ সালে মারভিন সিদ্ধান্ত নেন, অনেক হয়েছে। এ বার নিজের ব্যবস্থা নিজেই করবেন। বছর কয়েক আগে একটি বুলডোজ়ার কিনেছিলেন তিনি। সেই বুলডোজ়ারই ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন মারভিন।
নিজের কোমাৎসু ডি৩৫৫এ বুলজোডাজ়ারকে ‘কিলডোজ়ার’-এ পরিণত করেছিলেন মারভিন। প্রায় দেড় বছর ধরে চলেছিল প্রক্রিয়া।
বুলডোজ়ারের কেবিন, ইঞ্জিনের একাংশ ইস্পাতের পাত দিয়ে মুড়ে ফেলেন মারভিন। কেবিনের সামনের কাচও যে হেতু ঢাকা পড়ে যায়, তাই বুলডোজারের বাইরে একটি ভিডিয়ো ক্যামেরা বসান মারভিন।
সেই ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল বাইরের ধ্বংসলীলা। কেবিনে রাখা ছিল দু’টি মনিটর। সেই মনিটরে চোখ রেখে মারভিন দেখেছিলেন বাইরের ভিডিয়ো।
চালকের যাতে গরম না লাগে, তাই কেবিনের ভিতরে ছিল এসি এবং ফ্যান। কেবিনের মধ্যে গোটা তিনেক বন্দুক রেখেছিলেন মারভিন।
বুলডোজ়ারের কেবিনকে প্রায় কন্ট্রোল রুমে পরিণত করেছিলেন মারভিন। এমন ভাবে তা তৈরি করেছিলেন যে, এক বার তার ভিতরে প্রবেশ করলে বাইরে বার হওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। তদন্তকারীরা মনে করেন, ওই কন্ট্রোল রুম থেকে কোনও দিন বেরোনোর ইচ্ছাও ছিল না মারভিনের।
২০০৪ সালের ৪ জুন হামলা চালিয়েছিলেন মারভিন। নিজের দোকানে বসেই বিশেষ রূপ দিয়েছিলেন বুলডোজ়ারটিকে। ঘটনার দিন দোকানের দেওয়াল ভেঙে বার করেন সেই বুলডোজ়ার।
এর পর একে একে একটি কারখানা, টাউন হল, সংবাদপত্রের দফতর, প্রয়াত এক বিচারকের স্ত্রীর বাড়ি, একটি হার্ডওয়্যারের দোকান গুঁড়িয়ে দিতে দিতে এগিয়ে গিয়েছিল বুলডোজ়ারটি। পরে তদন্তকারীরা দেখেছিলেন, যে যে নির্মাণ গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন মারভিন, সেগুলির সঙ্গে তাঁর মামলার যোগ ছিল। ওই নির্মাণগুলি সরাতে বলে আগেই মামলা করেছিলেন তিনি।
নির্মাণগুলি ধ্বংস করতে করতে যখন মারভিনের বুলডোজ়ারটি এগিয়ে আসছিল, তখন তা লক্ষ্য করে একাধিক গুলি ছোড়ে পুলিশ। তাতে যদিও বুলডোজ়ারের খুব একটা ক্ষতি হয়নি। কারণ এ রকম হতে পারে আঁচ করেই কেবিনটি লোহার পাতে মুড়ে ফেলেছিলেন মারভিন।
২ ঘণ্টা ৭ মিনিট ধরে চলেছিল ধ্বংসলীলা। মোট ১৩টি নির্মাণ ধ্বংস করেছিলেন মারভিন।
শেষে নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেছিলেন মারভিন। জানা গিয়েছে, গ্রেফতারি এড়াতেই এই কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন তিনি।
৭০ লক্ষ ডলারের সম্পত্তি নষ্ট হয়েছিল মারভিনের এই হামলায়। ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৫৭ কোটি টাকা। যদিও মারভিন ছাড়া আর কারও প্রাণ যায়নি।
ঘটনার পর মারভিনের বাড়ি এবং দোকানে তল্লাশি চালায় পুলিশ। সেখানে উদ্ধার হওয়া জিনিসপত্র থেকে তারা জানতে পারে, অনেক দিন ধরেই হামলার পরিকল্পনা করছিলেন মারভিন। বুলডোজ়ারকে নিজের দোকানে বসে যখন নতুন রূপ দিচ্ছিলেন তিনি, অনেক গ্রাহকই তা লক্ষ্য করেন। তবে কিছুই বুঝতে পারেননি।
সাংবাদিক প্যাট্রিকের মতে, মানসিক অসুস্থতা থাকতে পারে মারভিনের। তবে তিনি এক প্রকার নিশ্চিত, আত্মম্ভরিতা, অহঙ্কার থেকে এই পদক্ষেপ করেছিলেন তিনি। অনেকে আবার মনে করেন, স্থানীয় ব্যবসাকে পথে বসানোর যে প্রবণতা সরকারের রয়েছে, তার বিরুদ্ধেই গর্জে উঠেছিলেন মারভিন। তবে অনেকেই আবার এই তত্ত্ব মানতে চান না। তাঁরা মনে করেন, মারভিনের এই পদক্ষেপে প্রাণ যেতে পারত বহু মানুষের। তাই তাঁকে অপরাধী বলেই গণ্য করা উচিত।