শুক্রবার, তৃণমূলের শহিদ সমাবেশ সংগঠিত হল আগের চেয়েও সংগঠিত ভাবে। বক্তার তালিকা বরাবরই তৈরি থাকে। কিন্তু এ বার বক্তাদের বক্তব্যের বিষয়ও বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। কারও তাল কাটলে ছিল মৃদু ধমকানিও। মূল বক্তা বরাবরের মতোই ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সদ্যসমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনে জয়ের পর এবং ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল নেত্রী কী বার্তা দেন, সে দিকে তাকিয়ে ছিল রাজনৈতিক মহল। মমতার পাশাপাশি দলের ‘সেনাপতি’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য শোনার জন্যেও মুখিয়ে ছিলেন আগত নেতা-কর্মীরা। মমতা-অভিষেক ছাড়াও ২১ জুলাইয়ের সভামঞ্চ থেকে দলীয় কর্মী-সমর্থকের বিশাল এবং বিপুল সমাবেশের সামনে ভাষণ দিলেন তৃণমূলের নেতা-নেত্রীরা। এক ঝলকে ২১ জুলাইয়ের এমনই নানা মুহূর্ত।
সঞ্চালনার দায়িত্ব ছিল মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের হাতে। বক্তাদের নাম ঘোষণা থেকে শুরু করে যথাসময়ে নেতাদের বক্তৃতা শেষ করার পুরো বিষয়টির তত্ত্বাবধানে ছিলেন অরূপ।
প্রথম বক্তৃতা দেন তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী। তিনি বলেন, ‘‘১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই সচিত্র পরিচয়পত্রের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন তৎকালীন যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তখনই পুলিশের গুলিতে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। অনেক পরে নির্বাচন কমিশন সেই দাবি কার্যকর করে সচিত্র পরিচয়পত্র দিয়ে ভোটদানের ব্যবস্থা চালু করে। নেত্রী সে দিন যা ভেবেছিলেন, সারা দেশ তা পরে ভেবেছিল।’’
বক্সীর পরে ভাষণ দিতে মঞ্চে ওঠেন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেত্রী রাজন্যা হালদার। তিনি বলেন, ‘‘আমরা সমবেত হয়েছি আমাদের নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী এবং আমাদের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে থেকে দিক্নির্দেশিকা পেতে। ২০২৪ সালে বিজেপিকে সরাতে তাঁদের নেতৃত্বে, তাঁদের নির্দেশে আমরা কাজ করব। দিল্লি থেকে বিজেপি সরকারকে সরাব।’’
তৃণমূলের রাজ্যসভার মনোনীত প্রার্থী প্রকাশ চিক বরাইক বলেন, ‘‘উত্তরবঙ্গের মানুষ বিজেপির ভাঁওতাবাজি ধরে ফেলেছেন। তাই তাঁরা পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলকে ঢেলে ভোট দিয়েছেন। বিজেপিকে হারিয়ে তাদের ধরাশায়ী করেছেন। আগামী লোকসভা ভোটে উত্তরবঙ্গ থেকে বিজেপি সাফ হয়ে যাবে।’’
মন্ত্রী বিরবাহা হাঁসদা বলেন, ‘‘বিজেপি আদিবাসীদের আবেগ নিয়ে ছলনা করেছে। সেই ছলনার জবাব দেওয়ার সময় আসছে। তাই কেন্দ্রের মোদী সরকারকে জবাব দিতে আদিবাসী ভাই-বোনদের বলব, জোটবদ্ধ হন। যাতে আর কোনও দিন কোনও রাজনৈতিক দল আদিবাসীদের ভাবাবেগ নিয়ে খেলা না করতে পারে।’’
পদ্মশিবিরকে আক্রমণ করে পঞ্চায়েত প্রতিমন্ত্রী শিউলি সাহা বলেন, ‘‘বিজেপির নেতারা এখানে বড় বড় কথা বলছেন! বিজেপি শাসিত রাজ্যে কী হচ্ছে, তা দেখতে পাচ্ছেন না। আগে নিজেদের ঘর সামলান। তার পর বাংলার কথা ভাববেন। মুখ্যমন্ত্রী বাংলাকে রক্ষা করেছেন এবং রক্ষা করবেন।’’
পরিষদীয় মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই দিনটি কখনও ভোলা যাবে না। কী ভাবে বাম সরকারের পুলিশ আমাদের তরতাজা ১৩ জন কর্মীকে গুলি করে হত্যা করেছিল, তা মনে থাকবে। সে দিন রাজপথে রক্তনদীর ধারা বয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলার মানুষ শেষে তাদের বিদায় করেছেন। তাঁর নেতৃত্বেই দিল্লিতে বিজেপি পরাস্ত হবে।’’
বনগাঁ সাংগঠনিক জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস। তিনি বলেন, ‘‘বনগাঁ এবং রানাঘাটে বিজেপি সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়েছিল। কিন্তু মানুষের সেই ভুল ভেঙে গিয়েছে। তাই তাঁরা পঞ্চায়েতে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন। সিএএ এবং এনআরসি নিয়ে মতুয়াদের ভুল বুঝিয়েছিল বিজেপি।’’ বক্তৃতা শেষে অবশ্য সঞ্চালক অরূপের কাছ থেকে মৃদু ধমক খান তিনি। সূত্রের খবর, তাঁকে বলা হয়, ‘‘তোকে যে কথা বলতে বলা হয়েছিল, সেটাই তো বলতে পারলি না!’’
জয়নগরের সাংসদ প্রতিমা মণ্ডল বলেন, ‘‘আর আট-ন’মাসের মধ্যেই লোকসভা নির্বাচন। এই সেই সুযোগ, যাতে আপনারা দিল্লি থেকে বিজেপির এই স্বেচ্ছাচারী সরকারকে হটাতে পারবেন। ‘ইন্ডিয়া’ যে জোট হয়েছে, তার নেতৃত্বে রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নেতৃত্বেই আপনারা সকলে বিজেপিকে হারাতে জোটবদ্ধ হন। আমাদের নেত্রীই পারবেন এই সরকারকে উৎখাত করতে।’’
উত্তরবঙ্গে বিজেপিকে উৎখাত করার ডাক দেন সিতাইয়ের তৃণমূল বিধায়ক জগদীশচন্দ্র বর্মা বাসুনিয়া। তিনি বলেন, ‘‘উত্তরবঙ্গে বিভাজনের রাজনীতি করতে চাইছে বিজেপি। উত্তরবঙ্গ-দক্ষিণবঙ্গ ভাগ করতে চাইছে। বিভাজনের রাজনীতি করছে ওরা। তাই উত্তরবঙ্গের মানুষ ওদের ছুড়ে ফেলে দেবে। যাদের নেতৃত্বে বিজেপির পরাজয় নিশ্চিত, তাঁরা হলেন মমতা এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।’’
দার্জিলিঙের তৃণমূল নেতা অনীত থাপা বলেন, ‘‘২০০৭ সালে আমরা বিজেপির হাত ধরেছিলাম। ২০০৯ সালে আমাদের হাত ধরে বিজেপি বাংলায় এসেছিল। এ বার দার্জিলিঙে বিজেপি হারবে। কারণ, তারা পাহাড়ের মানুষকে মিথ্যা কথা বলেছে। মিথ্যার রাজনীতি বেশি দিন স্থায়ী হয় না।’’
তৃণমূলের লোকসভার দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে হারাতে নেতৃত্ব দেবেন আমাদের নেত্রী মমতা। আর বাংলাকে নেতৃত্ব দেবেন অভিষেক।’’
কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘‘মোদী সরকারের জমানায় মা-বোনেদের সম্ভ্রম লুট হচ্ছে। যে সব মহিলাকে অসম্মানিত হতে হচ্ছে, তাঁরা আমাদের মা-বোন-মেয়ে। মহিলাদের উপর অত্যাচার শেষ হওয়া দরকার। তার জন্য প্রয়োজন দিল্লি থেকে মোদী সরকারকে উৎখাত করা। সে জন্য ‘ইন্ডিয়া’ জোট গঠনের মাধ্যমে আমাদের নেত্রী কাজ শুরু করে দিয়েছেন।’’
বক্তৃতায় বার বার কিছু হিন্দি শব্দ ব্যবহার করেন অভিনেত্রী তথা যুব তৃণমূল সভানেত্রী সায়নী ঘোষ। তাঁর বক্তৃতা চলাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চে এসে পৌঁছনোয় খানিকটা তাল কাটে সায়নীর। তবে ইডি-সিবিআই নিয়ে বক্তৃতায় কিছু বলেননি তিনি। বিজেপিকে কটাক্ষ করে বলেন, ‘‘ন’বছর আগে আপনারা পকেটে করে টাকা নিয়ে গিয়ে থলে ভরে বাজার করে আনতেন। আর এখন থলে ভরে টাকা নিয়ে গিয়ে পকেটভর্তি বাজার নিয়ে আসেন। দ্রব্যমূল্য কত বৃদ্ধি পেয়েছে, তা আপনারা সকলেই জানেন নিশ্চয়ই। তার জন্য আগামী লোকসভা ভোটে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে হটাতে হবে।’’
যুব তৃণমূল নেত্রী সায়নীর পরেই ভাষণ দিতে ওঠেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। দুপুর ১২টা ২৫ মিনিটে সভামঞ্চে পৌঁছেছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক।
কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ১০০ দিনের টাকা আদায় করতে ২ অক্টোবর গান্ধীজয়ন্তীতে ‘দিল্লি চলো’র ডাক দেন অভিষেক। ২ অক্টোবর দিল্লিতে কৃষিভবনের সামনে অবস্থান-আন্দোলন হবে বলে জানান তিনি। এ ছাড়া আগামী ৫ অগস্ট রাজ্যে বিজেপি নেতাদের বাড়ি ঘেরাও কর্মসূচির ডাক দেন তিনি।
অভিষেকের বক্তৃতার পর মঞ্চের সামনে এসে মাইক হাতে গান ধরেন সঙ্গীতশিল্পী নচিকেতা চক্রবর্তী। নিজের জনপ্রিয় গান ‘যখন সময় থমকে দাঁড়ায়’ গান তিনি।
নচিকেতার গান শেষ হওয়ার পর বক্তৃতা শুরু করেন মমতা। মণিপুর থেকে পঞ্চায়েত ভোটে হিংসা— নানা বিষয়ে বিজেপিকে আক্রমণ করেছেন তৃণমূল নেত্রী। মমতার বক্তৃতার সময় বৃষ্টি শুরু হয়। যা দেখে তৃণমূল নেত্রী বলেন, ‘‘এটা হয়তো ভগবানের আশীর্বাদ। আবার শহিদদের চোখের জল।’’ প্রতি বছরই ২১ জুলাইের সভামঞ্চে বৃষ্টি হয়। প্রকৃতির এমন খেয়ালকে ‘শুভ’ হিসাবে দেখে জোড়াফুল শিবির।
মঞ্চে ছিলেন চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন। সম্প্রতি তাঁর বিভিন্ন মন্তব্য ঘিরে রাজ্য রাজনীতিতে ‘বিতর্ক’ তৈরি হয়েছিল। পঞ্চায়েত ভোটে হিংসা কেন, প্রশ্ন তুলে আবার ‘পরিবর্তন’ চেয়ে মিছিলে হাঁটার কথা শুনিয়েছিলেন শুভাপ্রসন্ন। যদিও ফলঘোষণার পরে তিনি নিজের বক্তব্য বদলে নেন। তাঁর উপস্থিতি আলাদা করে নজর কেড়েছে।
তৃণমূলের শহিদ সমাবেশের মঞ্চ মানে তারকাদের ভিড়। এ বারও ধর্মতলার মঞ্চে ছিলেন তৃণমূলের তিন তারকা সাংসদ দেব, নুসরত জাহান এবং মিমি চক্রবর্তী। যোগ দিয়েছিলেন টলিপাড়ার বেশ কিছু পরিচিত মুখ।