মোবাইল, ক্যামেরা, ল্যাপটপ, টিভি— বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতিতে (ডিভাইস) ছেয়ে আছে চারদিক। এই যন্ত্রপাতির অন্যতম চালিকাশক্তি চিপ। যে কোনও যন্ত্রেই তথ্য সংরক্ষণের জন্য মাইক্রোচিপ কাজে লাগে।
বৈদ্যুতিন যন্ত্রগুলির হার্ডডিস্ক তৈরি হয় মাইক্রোচিপের মাধ্যমে। সেই চিপ তৈরির অত্যাবশ্যকীয় উপাদান সেমিকন্ডাক্টর। বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে যার গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সেমিকন্ডাক্টরের গুরুত্ব এতই বেড়ে গিয়েছে যে, আগামী দিনে এই ছোট্ট চিপই হয়ে উঠতে পারে বড়সড় যুদ্ধের বারুদ। বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দুই দেশ আমেরিকা এবং চিনের মধ্যে সেমিকন্ডাক্টরকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বও দীর্ঘ দিনের।
মোবাইল, কম্পিউটার থেকে ই-ভেহিকল, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র কিংবা পারমাণবিক অস্ত্র, সেমিকন্ডাক্টর সব ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলি এই সেমিকন্ডাক্টরের উপরেই ভরসা করে থাকে।
বিশ্ব জুড়ে প্রতি বছর এক লক্ষ কোটিরও বেশি মাইক্রোচিপ তৈরি হয়। বিশ্বে সেমিকন্ডাক্টর তৈরির সবচেয়ে বড় সংস্থা তাইওয়ানের ফক্সকন। তাইওয়ানের ১৫ শতাংশ জিডিপি এই সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের উপরেই নির্ভরশীল।
সেমিকন্ডাক্টর তৈরি হয় কী দিয়ে? এ ক্ষেত্রে দু’টি মূল উপাদানের নাম সিলিকন এবং গ্যালিয়াম আর্সেনাইড (পরিবর্তে গ্যালিয়াম নাইট্রাইডও ব্যবহার করা যেতে পারে)।
সিলিকন এবং গ্যালিয়ামের উৎপাদনের ঘাঁটি হল চিন। বিশ্বের মোট সিলিকনের ৬৮ শতাংশ এবং মোট গ্যালিয়ামের ৯৭ শতাংশ চিনে উৎপাদিত হয়। আমেরিকাতেও সিলিকন উৎপন্ন হয়। তবে তারা চিনের চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে।
চিপের লড়াইয়ে আমেরিকা এগিয়ে অন্য জায়গায়। উৎপাদন চিনে বেশি হলেও চিপ নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে আমেরিকা বিশ্বসেরা। তথ্যপ্রযুক্তিগত গবেষণা এবং উন্নয়নে আমেরিকা সবচেয়ে বেশি খরচ করে। তাই সেমিকন্ডাক্টরের বিশ্বজনীন বাজার এখনও তাদেরই দখলে।
চিনকে সেমিকন্ডাক্টর তৈরির কাঁচামালের ‘কারখানা’ বলা হয়। আবার কাঁচামালের জোগান দেওয়া সেই চিনকেই কিন্তু বাইরে থেকে সেমিকন্ডাক্টর আমদানি করতে হয়। তথ্যপ্রযুক্তিগত উন্নয়নে পিছিয়ে থাকার কারণে চিনে তেমন ভাল সেমিকন্ডাক্টর তৈরি হয় না। এখানকার সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইনিং ইন্ডাস্ট্রিও বেশ দুর্বল।
করোনা অতিমারি মাইক্রোচিপের এই বিশ্বজনীন দ্বন্দ্বকে আরও উস্কে দিয়েছে। লকডাউনের ফলে মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাড়িতে সময় কাটিয়েছে। ফলে কম্পিউটার, মোবাইলের মতো ব্যক্তিগত ডিভাইসগুলির চাহিদা আরও বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে সেমিকন্ডাক্টরের চাহিদা।
চিনের প্রযুক্তি সংস্থা হুয়াওয়েই এবং এসএমআইসির উপর সম্প্রতি নিরাপত্তাজনিত কারণে রফতানির কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে আমেরিকা। এর পরেই সেমিকন্ডাক্টরের জন্য চিন আমেরিকার উপর কতটা নির্ভরশীল, তা প্রকাশ্যে এসেছে।
একই সঙ্গে আমেরিকার সংস্থাগুলির উপরেও বিধিনিষেধের প্রভাব পড়েছে। সেমিকন্ডাক্টর তৈরির প্রক্রিয়া এবং বিক্রির জন্য আমেরিকা নিজেও চিনের উপর নির্ভরশীল। সেমিকন্ডাক্টর থেকে আমেরিকা যে রাজস্ব পায়, তার দুই পঞ্চমাংশ আসে চিনের বাজার থেকেই।
চিন, আমেরিকার এই দ্বন্দ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে তাইওয়ানেরও। চিনের উপকণ্ঠে এই দ্বীপরাষ্ট্রের উপর সেমিকন্ডাক্টরের জন্য আমেরিকা এবং চিন উভয়ই নির্ভর করে। চিপের বাজারের অন্যতম নিয়ন্ত্রক তাইওয়ান।
তাইওয়ানে অস্থিরতার নেপথ্যেও রয়েছে এই টানাপড়েন। চিনের সংস্থাগুলির উপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার ফলে তাইওয়ানও তাদের সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারছে না। এর ফলে ভবিষ্যতে চিনের তাইওয়ান আক্রমণের আশঙ্কা আরও তীব্র হতে পারে।
চিন এবং তাইওয়ানের রাজনৈতিক মতানৈক্যও চিপের বাজারে প্রভাব ফেলে। তাইওয়ানের স্বতন্ত্রতা আলাদা করে স্বীকার করে না চিন। আমেরিকা আনুষ্ঠানিক ভাবে সেই তত্ত্বে সায় দিলেও সেই আমেরিকাই আবার তাইওয়ানকে চিনের বিরুদ্ধে সামরিক সহায়তাও প্রদান করে। এই জটিলতা সেমিকন্ডাক্টরের বাজারে নতুন সমীকরণের জন্ম দিয়েছে।
সেমিকন্ডাক্টরের বাজারে সম্প্রতি প্রবেশ করতে চাইছে ভারতও। ভারতে সেমিকন্ডাক্টর তৈরির কারখানা গড়তে তাইওয়ানের সংস্থা ফক্সকনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল মুম্বইয়ের বেদান্ত লিমিটেড। কেন্দ্রীয় সরকার উদ্যোগকে স্বাগতও জানিয়েছিল।
ফক্সকন এবং বেদান্তের প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের চুক্তি অবশ্য ভেস্তে গিয়েছে। তবে ফক্সকনের পিছু হটাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না বেদান্ত। তারা ভারতে অদূর ভবিষ্যতে সেমিকন্ডাক্টরকে কেন্দ্র করে বাণিজ্য গড়তে এখনও বদ্ধপরিকর।
ভারতে সেমিকন্ডাক্টর গড়তে উৎসাহী মোদী সরকারও। তারা সম্প্রতি সেমিকন্ডাক্টরের উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য প্রযুক্তি সংস্থাগুলিকে ৫০ শতাংশ ছাড় দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে।
চিনের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক খুব একটা ভাল নয়। ফলে সেমিকন্ডাক্টরের দুনিয়ায় বেজিং ভারতকে কতটা মাথা তুলতে দেবে, না নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে দেশের তরুণ প্রজন্মকে কাজে লাগিয়ে এই বাজারে ভারতের অগ্রগতিও অসম্ভব নয়।
টাইমস অফ ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে ভারতের সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইন ইন্ডাস্ট্রি ৩,৩০০ কোটি ডলার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এই বাজারে মাথা তুলতে হলে অন্য দেশের সাহায্যও ভারতের প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে আমেরিকা ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, জাপানের কথা ভাবতে পারে দিল্লি।