একই দিনে দুই দুঃসংবাদ বাংলার বিনোদন জগতে। মঙ্গলবার সকালে মৃত্যু হয়েছে বর্ষীয়ান সঙ্গীতশিল্পী সুমিত্রা সেনের। আর বেলা গড়াতে না গড়াতেই অকালপ্রয়াণ ঘটল টলিপাড়ার বিখ্যাত পরিচালক অঞ্জন চৌধুরীর পুত্র সন্দীপ চৌধুরীর। বয়স হয়েছিল ৪৪। বাবার মতো সন্দীপও ছবির পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে বাংলা ছবির থেকে ধারাবাহিকেই তাঁর বিস্তার ছিল বেশি।
মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বাবার মতো বাঙালির ঘরে ঘরে ছেলের নাম তেমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি ঠিকই, কিন্তু টলিপাড়ায় সন্দীপ ছিলেন সুপরিচিত।
অঞ্জনের তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে সন্দীপ ছিলেন মেজো। দিদি চুমকি চৌধুরী এবং বোন রীনা চৌধুরী বাবার হাত ধরে প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে টলিপাড়ায় চুটিয়ে অভিনয় করেছেন। কিন্তু অভিনয়ের দিকে সন্দীপের বিশেষ কোনও আগ্রহ ছিল না। বেশি ঝোঁক ছিল বাবার মতো পরিচালনায়।
চুমকি এবং রীনার মতোই টলিউডে সন্দীপের প্রবেশ বাবা অঞ্জনের হাত ধরে। বাবার সঙ্গে বেশ কিছু দিন সহকারী পরিচালক হিসাবেও কাজ করেছেন সন্দীপ।
টলিপাড়ায় প্রচলিত ছিল যে, বাঙালি সংসারের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্কের বুনট, ভালবাসা, জটিলতা পরিচালক অঞ্জনের মতো অন্য কোনও পরিচালক বুঝতেন না। আর সেই জন্যই হয়তো বাঙালি সংসারের পটভূমিতে ‘গুরুদক্ষিণা’, ‘চৌধুরী পরিবার’, ‘বড় বউ’, ‘ছোট বউ’-এর মতো একের পর এক ছবি বাঙালিদের উপহার দিয়ে গিয়েছেন তিনি।
পরের দিকে ধারাবাহিকের পরিচালনাতেও নেমেছিলেন অঞ্জন। ‘এরাও শত্রু’ নামে জনপ্রিয় ধারাবাহিকের পরিচালনা করার সময় তিনি প্রয়াত হন। তাঁর মৃত্যুর পর সেই ধারাবাহিক পরিচালনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন পুত্র সন্দীপ।
বাবা-ছেলের হাত ধরে ‘এরাও শত্রু’ সেই সময় বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় এবং সফল ধারাবাহিকে পরিণত হয়েছিল।
এর পর থেকে একের পর এক ধারাবাহিকে পরিচালক, সৃজনশীল পরিচালক হিসাবে কাজ করে গিয়েছেন সন্দীপ। সম্প্রতি ‘উড়নতুবড়ি’ ধারাবাহিকের সৃজনশীল পরিচালক হিসাবে কাজ করছিলেন তিনি।
এ ছাড়াও টুকটাক ছবির পরিচালনাও করেছেন অঞ্জন-পুত্র। তবে সেই ছবিগুলি আহামরি জনপ্রিয়তা পায়নি। আর সেই কারণেই বাঙালির ঘরে ঘরে অতি পরিচিত হয়ে ওঠা হয়নি সন্দীপের। আরও বেশ কয়েকটি গল্প নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা ছিল সন্দীপের। কিন্তু শেষমেশ তা আর হয়ে ওঠেনি। ফলে বিগত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিক পরিচালনার কাজেই মন দিয়েছিলেন সন্দীপ।
ধারাবাহিকের পরিচালক এবং সৃজনশীল পরিচালক হিসাবে কাজ করা ছাড়াও একাধিক জনপ্রিয় ধারাবাহিকের চিত্রনাট্য এবং সংলাপ লেখার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সন্দীপ।
সন্দীপ সম্প্রতি টালিগঞ্জের ডিরেক্টর্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে কাজ করা কর্মীদের কথায়, টলিপাড়ার যে কোনও সমস্যার সমাধানে সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তেন সন্দীপ।
সন্দীপ বিয়ে করেন বিদিশা রায় চৌধুরীকে। বিদিশাও অভিনেত্রী। তাঁরও টলিউডে পদার্পণ শ্বশুরের হাত ধরে। অনেক সিনেমা এবং ধারাবাহিকে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। শ্বশুর-স্বামী ছাড়া অন্য পরিচালকদের সঙ্গেও তিনি কাজ করেছিলেন। বিদিশাকে শেষ দেখা গিয়েছিল সদ্য মুক্তি পাওয়া ‘এভারেস্ট’ ছবিতে।
গত ১৭ ডিসেম্বর ‘ফেরারি মন’ ধারাবাহিকে কাজ করার সময় শুটিং ফ্লোরে হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন সন্দীপ। ইকবালপুরের এক নার্সিং হোমে ভর্তি করানো হয় তাঁকে।
দীর্ঘ দিন তিনি কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর শরীরে ইউরিয়া এবং ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। রক্তে শর্করার মাত্রাও বেড়ে গিয়েছিল। এর পর মঙ্গলবার নার্সিংহোমে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই মৃত্যু হয় সন্দীপের।
চার মাস আগেই প্রয়াত হয়েছেন অঞ্জনের স্ত্রী তথা চুমকি-সন্দীপ-রীনার মা। সন্দীপের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ সারা পরিবার। ভাইয়ের আকস্মিক প্রয়াণে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন শোকস্তব্ধ চুমকি চৌধুরী এবং রিনা চৌধুরী।