রাশিয়ার গ্যাস সংস্থার কোটিপতি কর্তা সের্গেই প্রোটোসেনিয়ার রহস্যজনক মৃত্যুর তদন্ত নেমেছে স্পেনের তদন্ত সংস্থাগুলি। স্পেনের কোস্টা ব্রাভাতে নিজের প্রাসাদোপম বাড়ির ভিতরে ঝুলন্ত অবস্থায় তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। উদ্ধার করা হয় তাঁর স্ত্রী এবং মেয়ের রক্তাক্ত দেহ-ও। তাঁর স্ত্রী এবং মেয়েকে কুপিয়ে খুন করা হয় বলে প্রাথমিক ভাবে অনুমান পুলিশের।
তদন্ত সংস্থাগুলির ধারণা ৫৫ বছর বয়সি সের্গেই একটি কুড়ুল এবং ছুরি দিয়ে নিজেই স্ত্রী এবং মেয়েকে খুন করে আত্মহত্যা করেন। সের্গেইয়ের পরিবার ফ্রান্সে বাস করত। স্পেনে তাঁরা ছুটি কাটাতে এসেছিলেন।
তবে ঘটনাস্থলে কোনও সুইসাইড নোট পাওয়া যায়নি। উদ্ধার হওয়া কুড়ুল এবং ছুরি থেকে পাওয়া যায়নি আঙুলের ছাপও। আর তা নিয়েই ঘনীভূত হয়েছে রহস্যের জাল। আত্মহত্যার আগে কেনই বা আঙুলের ছাপ মেটানোর কথা ভেবেছিলেন সের্গেই? উঠে আসছে সে প্রশ্নও।
স্পেনের পুলিশ জানিয়েছে যে, সের্গেই তাঁর স্ত্রী এবং মেয়েকে ঘুমন্ত অবস্থায় একটি কুড়ুল এবং একটি ছুরি দিয়ে খুন করে পরে ওই বাড়ির বাইরে রেলিং থেকে ঝুলে আত্মহত্যা করেন।
যদিও দাম্পত্য কলহ বা অশান্তির কোনও প্রমাণ পুলিশের হাতে আসেনি। বাড়িতে বাইরে থেকে কেউ প্রবেশ করেছিল কি না তা দেখতে ইতিমধ্যেই সিসি ক্যামেরাগুলি খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে পুলিশ।
সের্গেই এবং তাঁর পরিবারের দেহ উদ্ধার করা হয় মঙ্গলবার। আশ্চর্যজনক ভাবে ঠিক তার এক দিন আগেই মস্কোর বিলাসহুল বহুতলের ১৫ তলা থেকে উদ্ধার করা হয় স্ত্রী এবং ছোট মেয়ের মৃতদেহ-সহ অন্য এক রাশিয়ার কোটিপতি ব্যবসায়ীর মৃতদেহ। তিন জনের মৃতদেহই গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে বাড়ির বড় মেয়ে আনাস্তাসিয়া।
কোটিপতি ব্যবসায়ী ভ্লাদিস্লাভ আভায়েভ, তাঁর স্ত্রী ইয়েলেনা এবং নাবালিকা মেয়ে মারিয়া মৃতদেহগুলি পাশাপাশিই পড়ে ছিল। এ ক্ষেত্রেও তদন্তকারীদের দাবি ছিল, স্ত্রী-মেয়েকে গুলি করে আত্মহত্যা করেন আভায়েভ।
আনাস্তাসিয়া পুলিশকে জানান তিনি যখন তাঁর বাবার দেহ দেখতে পান, সেই সময় বন্দুকটি তাঁর হাতেই ছিল।
আনাস্তাসিয়ার মতে, বিলাসবহুল এই ফ্ল্যাটে মোট ১৩টি অস্ত্র ছিল। কিন্তু সে সব দেরাজে ভিতর থেকে তালাবদ্ধ অবস্থাতেই ছিল।
স্ত্রী ইয়েলেনা এবং তাঁর গাড়ির চালকের মধ্যে বিবাহ বর্হিভূত সম্পর্ক ছিল বলেও কানাঘুষোয় শোনা যেত। এর পরই ওই চালককে চাকরি থেকেও ছাড়িয়ে দেন আভায়েভ।
ক্রিস্টিনা নামে এক প্রতিবেশী জানান, তিনি পর পর তিনটি গুলির আওয়াজ এবং চিৎকার শোনেন। তবে খুব তাড়াতাড়িই চিৎকার থেমে যায়।
তবে এই অদ্ভুত ভাবে, ‘আত্মহনন’-এর পথ বেছে নেওয়া এই দুই ব্যবসায়ীই রাশিয়ার কোনও না কোনও গ্যাস সংস্থার সঙ্গে যুক্ত এবং সংস্থাগুলির উঁচু পদে ছিলেন।
তবে কিভের উপর ক্রেমলিন আগ্রাসনের পর রাশিয়ার তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর আমেরিকা-সহ বিশ্বের বহু দেশ নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর থেকেই সামগ্রিক ক্ষতির মুখে পড়ে এই সংস্থাগুলি।
ভারতীয় মুদ্রায় সের্গেই-র মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল তিন হাজার ২৫১ কোটি। এবং তিনি সাত বছর ধরে রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাস সংস্থা নোভেটেকের পরিচালনা পর্ষদের ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন।
আভায়েভ-ও এর আগে রাশিয়ার গ্যাস সংস্থা গ্যাজপ্রমের নিজস্ব ব্যঙ্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এ ছাড়াও আভায়েভ একটি নির্মাণ সংস্থার মালিকও ছিলেন।
ক্রেমলিন ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে এক সময় সেখানেও একটি বিভাগের উপপ্রধান ছিলেন আভায়েভ। পুতিন নিজেও অনেক বিদেশি সংস্থাকে এই ব্যঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলার অনুরোধ করেছিলেন। এই বিনিয়োগের সাহায্যে বেশি প্রাক়ৃতিক গ্যাস উৎপন্ন করে রাশিয়া, পশ্চিমী দেশগুলিকে টেক্কা দিতে পারে বলেও উল্লেখ করেছিলেন পুতিন।
রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের পর রুশ অর্থনীতিতে প্রভাব পড়লে পুতিন জানিয়েছিলেন যে, বিদেশি মুদ্রার সাহায্যে রুশ অর্থনীতি চাঙ্গা করা সম্ভব। কিন্তু পরে নিজের কথা থেকে সরে আসেন তিনি।
এখন এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে যখন প্রাকৃতিক গ্যাস রফতানি ক্ষতির মুখে পড়েছে, তখন হঠাৎ দুই প্রধান গ্যাস সংস্থার উচ্চপদস্থ দুই কর্মীর পর পর ‘আত্মহত্যা’ করার ঘটনা কি নিছকই কাকতালীয়? না কি এর পিছনে লুকিয়ে কোনও গভীর রহস্য? বাড়ছে রহস্য।