প্রতি বছর বড়দিনে পরিবারের সঙ্গে হইহই করে সময় কাটত। কিন্তু, এ বছর প্রিয়জনদের ছাড়াই ২৫ ডিসেম্বরের আনন্দ যাপন করতে হবে তাঁকে। তবে বড়দিনের আনন্দ এ বার তাঁর কাছে অনেকটাই ফিকে। গত ১০ মাস ধরে চলছে যুদ্ধ। যার জেরে হারিয়েছেন ভাইকে। বাধ্য হয়েই আপনজনদের ছেড়ে কয়েক হাজার মাইল টপকে ঠাঁই নিয়েছেন লন্ডনে। শুধু একটু নিরাপদে বাঁচার আশায়। একটা যুদ্ধ কী ভাবে তাঁর জীবন বদলে দিয়েছে, সেই কাহিনিই তুলে ধরেছেন ইউক্রেনের টিকটকার ভ্যালেরিয়া শশেনোক।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। ইউক্রেনের মাটিতে আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া। সেই থেকেই দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধের শুরু। দেখতে দেখতে ১০ মাস হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখনও যুদ্ধ থামার কোনও লক্ষণ নেই। যত দিন গড়াচ্ছে, যুদ্ধের বীভৎসতা ততই বাড়ছে।
ভ্যালেরিয়ার মতোই ইউক্রেনের বহু নাগরিকের জীবনই বদলে গিয়েছে ২৪ ফেব্রুয়ারির পর থেকে। বহু মানুষ তাঁদের প্রিয়জনদের হারিয়েছেন। কেউ আবার জখম হয়েছেন। যুদ্ধের বীভৎসতায় কারও আবার ঘরবাড়ি ভেঙে গিয়েছে। অনেকে আবার প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। ঠিক যেমনটা করেছেন ইউক্রেনের ওই টিকটকার।
রুশ বাহিনীর আক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে বাবা-মায়ের সঙ্গে নিরাপদ আশ্রয়ে ছিলেন ভ্যালেরিয়া। সেই রাত যেন তাঁর কাছে এক ‘দুঃস্বপ্নের মতো’ ছিল। তাঁর কথায়, ‘‘এটা দুঃস্বপ্ন ছিল। ভাবতে পারিনি কখনও এমনটা ঘটতে পারে। বাবা-মায়ের সঙ্গে নিরাপদ আশ্রয় নিতে বম্ব শেল্টারে থাকতে হয়েছিল।’’
যুদ্ধে দেশের মানুষের মৃত্যু ঘটছে। বাতাসে বারুদের গন্ধ। ক্ষেপণাস্ত্রের কবলে পড়ে পুড়ছে ঘরবাড়ি। চোখের সামনে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখে ভ্যালেরিয়া ঠিক করেছিলেন দেশ ছেড়ে পালাবেন। শেষে বাধ্য হয়ে নিজের দেশ ছেড়েছিলেন ইউক্রেনের ২১ বছর বয়সি ওই তরুণী।
দেশ ছেড়ে পালানোর জন্য প্রথমে চেরনিহিভ থেকে গাড়িতে ৭ ঘণ্টার যাত্রা শেষে কিভে পৌঁছন ওই টিকটকার। তার পর সেখান থেকে ট্রেনে করে যান লিভিভে। এর পর আরও ১২ ঘণ্টা যাত্রা করে পোল্যান্ডে পৌঁছন। সেখানে ওয়ারশে বন্ধুর বাড়িতে প্রথমে আশ্রয় নিয়েছিলেন ওই তরুণী।
তার পর সেখান থেকে লন্ডনে পৌঁছেন ভ্যালেরিয়া। পুতিনের সৈন্যদলের আক্রমণের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে লন্ডনে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। কিন্তু তাঁর মন পড়ে রয়েছে ইউক্রেনে।
একটা অজানা দেশ, অচেনা শহর। কে আশ্রয় দেবেন তাঁকে? না, লন্ডনে পৌঁছে খুব একটা সমস্যার মুখে পড়তে হয়নি ওই তরুণীকে। সেখানকার এক বাসিন্দা নিখরচায় তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন ভ্যালেরিয়াকে। বর্তমানে ওই ব্রিটিশ পরিবারের সঙ্গেই দিনযাপন করছেন তিনি। এ বছর বড়দিনও ওই ব্রিটিশ পরিবারের সঙ্গেই কাটাবেন। তবে পাশে প্রিয়জনরা না থাকায় স্বাভাবিক ভাবেই মনখারাপ তাঁর।
যুদ্ধের বীভৎসতার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন ঠিকই। লন্ডনে ব্রিটিশ পরিবারের সঙ্গে নিজেকে মানিয়েও নিয়েছেন তিনি। কিন্তু হৃদয়ে রুশ আগ্রাসনের ক্ষতচিহ্ন রয়ে গিয়েছে। যা তাঁকে অনবরত অস্থির করে তুলছে। তাঁর পরিবারের বাকি সদস্যরা ইউক্রেনেই থাকেন। তাঁদের দুরবস্থার কথা ভাবলেই শিউরে ওঠেন তিনি।
ইউক্রেনের মাটিতে কতটা নির্মম ভাবে আক্রমণ চালিয়েছেন রুশ সৈনিকরা, তা দুনিয়ার কাছে তুলে ধরতে টিকটক ভিডিয়ো বানিয়েছেন ভ্যালেরিয়া। রুশ ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে তছনছ হয়ে গিয়েছে ইউক্রেনের বিভিন্ন এলাকা। ধ্বংসস্তূপের ভিডিয়ো করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন তিনি।
কয়েক মাস আগেই ইউক্রেনে ফিরেছিলেন ভ্যালেরিয়া। তখনই রুশ সেনার আক্রমণে বিপর্যস্ত ইউক্রেনের নানা জায়গার ভিডিয়ো করেছেন তরুণী। তাঁর কথায়, ‘‘এটা আমার কাছে একটা অস্ত্র। আমার দেশে কী ঘটছে, তা বাইরের দুনিয়াকে জানাতেই ভিডিয়ো বানিয়েছি।’’
এই যুদ্ধ তাঁর প্রিয়জনকে কেড়ে নিয়েছে। রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হয়েছে তরুণীর তুতো ভাই। যিনি ভ্যালেরিয়ার খুব কাছের ছিলেন। সেই যন্ত্রণা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন ভ্যালেরিয়া। তাঁর মতো অনেক ইউক্রেনের বাসিন্দাই তাঁদের আপনজনদের হারিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এটা খুবই যন্ত্রণাদায়ক। দেশের অবস্থা ভয়ঙ্কর।’’
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইউক্রেনে তাঁর পরিবারের সদস্যদের অসহায় অবস্থার কথা ভাবলে গলা বুজে আসে ভ্যালেরিয়ার। তিনি বলেছেন, ‘‘আমার বাবা-মায়ের বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। বন্ধুদের ঘরে জল নেই। এই শীতে কতটা খারাপ অবস্থা ওঁদের।’’
এক সময় যে কাকার বাড়িতে অনেকটা সময় কাটাতেন, সেই বাড়িটি যুদ্ধের কবলে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে। ভ্যালেরিয়া সেই বাড়িটি নতুন করে তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রুশ আক্রমণকে ‘গণহত্যা’ বলে বর্ণনা করেছেন ওই তরুণী। তাঁর কথায়, ‘‘বহু ইউক্রেনীয়র মৃত্যু হয়েছে। আমার দেশে গণহত্যা হয়েছে।’’
আর যুদ্ধ চান না ভ্যালেরিয়া, একটু শান্তি চান। ভাল ভাবে বাঁচতে চান। তাঁর যুদ্ধবিধ্বস্ত জীবনকে ভুলে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে চান। সে কারণেই নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যস্ত ভ্যালেরিয়া। তবে তাঁর দেশে যে অন্যায় হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রদর্শনে টিকটক ভিডিয়োকে কাজে লাগাবেন বলেই জানিয়েছেন ওই তরুণী।