সামরিক পরিভাষায় বলা হয় ‘জ্যাক ইন দ্য বক্স এফেক্ট’। ক্ষেপণাস্ত্র বা কামানের গোলার সাহায্যে শত্রুপক্ষের ট্যাঙ্ক বা সাঁজোয়া গাড়ির বহরে মজুত অস্ত্রসম্ভারে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আক্ষরিক অর্থে ‘উড়িয়ে দেওয়া’র পোশাকি নাম এটি। ইউক্রেন যুদ্ধের কয়েকটি ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে এমনই দৃশ্য।
সাম্প্রতিক রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে বার বারই দেখা গিয়েছে রুশ ট্যাঙ্কের উড়ে যাওয়ার ছবি। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা দফতরের হিসাব বলছে, ৬৪ দিনের যুদ্ধে অন্তত ৫৮০টি ট্যাঙ্ক হারিয়েছে রাশিয়া। ধ্বংস হয়েছে হাজারেরও বেশি সাঁজোয়া গাড়ি (ইনফ্যান্ট্রি ফাইটিং ভেহিকল্)।
রুশ টি-৭২ বা টি-৯০ ট্যাঙ্কে বসানো ১২৫ মিলিমিটারের ‘স্মুদবোর’ কামানের জন্য মজুত রাখা হয় কমবেশি ৪০টি গোলা। ইউক্রেন সেনার ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে সেই গোলার স্তূপে বিস্ফোরণ ঘটছে প্রায়শই। আর তার অভিঘাতে কার্যত শূন্যে উঠে যাচ্ছে ট্যাঙ্ক।
আমেরিকার তৈরি ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র (এটিজিএম) জ্যাভেলিনের পাশাপাশি ব্রিটেনের ‘ট্যাঙ্ক-ব্রাস্টার্স’ (পোশাকি নাম, ‘নেক্সট জেনারেশন লাইট অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক ওয়েপন’ বা এনএলএডব্লিউ) রুশ ট্যাঙ্ক ধ্বংসে ইউক্রেন সেনার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রথম দেখা গিয়েছিল ‘জ্যাক ইন দ্য বক্স এফেক্ট’। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের অভিঘাতে কয়েক টন ওজনের ইস্পাতের যুদ্ধযানের শূন্যে উঠে যাওয়ার দৃশ্য অবলম্বনে পরবর্তী কালে তৈরি হয়েছিল জনপ্রিয় ভিডিয়ো গেমস।
১৯৪৩ সালের জুলাই-অগস্টে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পর্বে রাশিয়ার কুর্স্ক এলাকায় হিটলারের সাধের প্যানজার ট্যাঙ্ক ডিভিশনকে ছিন্নভিন্ন করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে হারের জেরে হতোদ্যম জার্মান সেনা কুর্স্কের বিপর্যয়ের পরে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
১৯৬৫-র সেপ্টেম্বরে পঞ্জাব সীমান্তের খেমকরণে পাক সেনার ট্যাঙ্ক ব্রিগেডকে একই ভাবে চুরমার করেছিল ভারতীয় সেনা। সংখ্যা এবং অস্ত্রসম্ভারে অনেক পিছিয়ে থেকেও ভারতীয় সেনা পেয়েছিল নির্ণায়ক জয়।
খেমকরণে পাক বাহিনীর ব্যবহার করেছিল তৎকালীন বিশ্বের সেরা ট্যাঙ্ক, আমেরিকার তৈরি এম-৪৭ প্যাটন। পাশাপাশি, আমেরিকারই তৈরি হালটা ট্যাঙ্ক এম-২৪ শ্যাফি ছিল পাক সেনার হাতে। সংখ্যায় ২৬৪টি।
পাক হামলার জবাব দিতে ভারতীয় সেনার হাতিয়ার ছিল চল্লিশের দশকের ব্রিটিশ ভিকার্স (বিজয়ন্তা), সেঞ্চুরিয়ন আর শেরম্যান ট্যাঙ্ক। পাশাপাশি ছিল ফ্রান্সের তৈরি কয়েকটি হালকা ট্যাঙ্ক এএমএক্স-১৩। সব মিলিয়ে মাত্র ১৩৫টি।
পাক ট্যাঙ্ক বাহিনীকে ধ্বংস করতে কার্যকর ভূমিকা নিয়েছিল জিপে বসানো ১০৫ মিলিমিটারের এম-৪০ রিকয়েললেস রাইফেল। তার নিখুঁত নিশানায় প্রায়শই বিস্ফোরণ ঘটত পাক ট্যাঙ্কের অন্দরে। দু’দিনের যুদ্ধে ধ্বংস হয়েছিল শতাধিক পাক ট্যাঙ্ক।
ইউক্রেনে রুশ ট্যাঙ্কের ধারাবাহিক ‘জ্যাক ইন দ্য বক্স এফেক্ট’ আদতে নকশার ত্রুটি বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তাঁদের মতে, ট্যাঙ্কের অন্দরে এতগুলি গোলা রাখার ব্যবস্থা নিরাপদ নয়। ট্যাঙ্কে আঘাত লাগার মুহূর্তের মধ্যে বেরিয়ে না এলে চালক, পর্যবেক্ষক এবং গোলন্দাজের মৃত্যু অবধারিত।
রুশ বিএমবি-৪ বা বিএমপি-২ ‘ইনফ্যান্ট্রি কমব্যাট ভেহিকল্’গুলির অবস্থা আরও ভয়াবহ বলে মনে করেন তাঁরা। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনা বহনকারী এই যানগুলি মর্টার বা রকেট প্রফেল্ড গানের আঘাত হজম করতেও পুরোপুরি সক্ষম নয়। ইউক্রেন যুদ্ধে এগুলি কার্যত রুশ সেনার ‘মোবাইল কফিন’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় ইরাক যুদ্ধে আমেরিকার আর্মার্ড ব্রিগেডও ‘জ্যাক ইন দ্য বক্স এফেক্ট’এর শিকার হয়েছিল। তার পরেই আমেরিকার ও পশ্চিমী দেশগুলির ট্যাঙ্কের নকশায় আমূল পরিবর্তন করা হয়।
আমেরিকায় এম-১ আব্রাহাম ট্যাঙ্কে গোলা ও বিস্ফোরক ভিতরে রাখা হয় না, বাইরে ইস্পাতের একটি পৃথক বাক্সে মজুত থাকে। ফলে শত্রুসেনার হামলায় বিস্ফোরণ ঘটলেও ট্যাঙ্কটি পুরোপুরি ধ্বংস হয় না। সেনারাও প্রাণের বেঁচে যান।