ইউক্রেনের সঙ্গে দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধ বড়সড় প্রভাব ফেলেছে রাশিয়ার অর্থনীতিতে। আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়া এই যুদ্ধের জন্য দায়ী করেছে রাশিয়াকে। রাশিয়াকে ‘ভাতে মারতে’ সে দেশ থেকে অশোধিত তেল কেনা বন্ধ রেখেছে পশ্চিমের দেশগুলি।
অন্য দেশগুলিও যাতে রাশিয়া থেকে তেল না কেনে, সেই বিষয়েও যাবতীয় উদ্যোগ নিয়েছে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্সের মতো দেশগুলি। এই পরিস্থিতিতে ভাঁড়ারে টান পড়ার আশঙ্কা করছে ভ্লাদিমির পুতিনের দেশ।
কয়েক দিন আগেই দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসাবে এক অর্থনীতি বিশেষজ্ঞকে নিয়োগ করেছেন পুতিন। মনে করা হচ্ছে যুদ্ধের খরচে লাগাম টানতেই এই পদক্ষেপ করেছে ক্রেমলিন।
অন্য দিকে জলে, স্থলে দু’জায়গাতেই এ বার পরমাণু চুল্লি গড়তে চলেছে ভারত। সৌজন্যে সেই রাশিয়া। এই বিষয়ে নয়াদিল্লিকে সব রকম সাহায্য করার আশ্বাস দিয়েছে মস্কো।
সম্প্রতি রাশিয়ার সরকারি পরমাণু সংস্থা ‘রোসাটম’-এর প্রধান অ্যালেক্সেই লিখাচেভের সঙ্গে সাইবেরিয়ায় গিয়ে বৈঠক করেন ভারতের ‘অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন’-এর প্রধান অজিতকুমার মোহান্তি।
রুশ সংবাদমাধ্যম ‘রাশিয়া টুডে’র প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতের প্রতিনিধিকে অত্যাধুনিক পরমাণু কেন্দ্র ঘুরিয়েও দেখান রুশ প্রতিনিধি। ওই প্রতিবেদন অনুসারে, ভবিষ্যতে বিশ্বের ‘সর্বাধিক সুরক্ষিত’ পরমাণু চুল্লি তৈরি হতে চলেছে ওই কেন্দ্রে।
দুই দেশের পরমাণু বিষয়ক বৈঠকে ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকের শেষে লিখাচেভ জানান, রাশিয়া পরমাণু শক্তির ব্যবহার নিয়ে ভারতের সঙ্গে আরও নিবিড় ভাবে কাজ করার বিষয়ে আগ্রহী।
বৈঠকে স্থির হয়েছে ভারতের একাধিক নতুন জায়গায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পরমাণু কেন্দ্র তৈরি করা হবে। এই পরমাণু কেন্দ্রগুলি তৈরি করা হবে রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়।
প্রাথমিক ভাবে ঠিক হয়েছে, সমুদ্র উপকূলবর্তী স্থলভাগে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পরমাণু কেন্দ্র তৈরি করার পাশাপাশি তুলনায় কম শক্তির ভাসমান পরমাণু কেন্দ্র তৈরিতে ভারতকে সহায়তা করবে রাশিয়া।
এ ছাড়াও তামিলনাড়ুর কুড়ানকুলাম পরমাণু কেন্দ্রে কাজের অগ্রগতি নিয়ে কথা হয়েছে দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে। রাশিয়ার একটি সরকারি সংস্থা এবং ভারতের ‘নিউক্লিয়ার পাওয়ার কর্পোরেশন’-এর যৌথ উদ্যোগে তৈরি হওয়া এই পরমাণু কেন্দ্রে ৬০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি হতে পারে।
ইতিমধ্যেই এই পরমাণু কেন্দ্রটির দু’টি চুল্লি বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করছে। আরও দু’টি তৈরির কাজ চলছে। সেখানে আরও দু’টি চুল্লি তৈরির পরিকল্পনা করেছে নয়াদিল্লি এবং মস্কো।
তবে দুই দেশের বৈঠকের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হল ভাসমান পরমাণু কেন্দ্র। রাশিয়ার সহায়তায় এই জিনিস ভারতের হাতে এলে শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমূল বদল ঘটবে দেশে।
শিল্পীর কল্পনাসৃষ্ট ভাসমান পরমাণু কেন্দ্রের যে ছবি প্রকাশ্যে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে জলরাশির মধ্যে সুবিশাল ভেসেল। আর তার ঠিক মাঝখানে রয়েছে গোলাকার পরমাণু কেন্দ্র। চার কোণে থাকা চারটি চুল্লি থেকে অনবরত ধোঁয়া উঠছে।
রাশিয়ার সহায়তায় এই ভাসমান পরমাণু কেন্দ্র দেশের উপকূলবর্তী এলাকা ধরে ধীর গতিতে এগোতে পারবে। যে কোনও এলাকায়, যে কোনও পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের প্রয়োজন হলে, নিরবচ্ছিন্ন ভাবে তার জোগান দিতে পারবে এই কেন্দ্র।
এত দিন পর্যন্ত পরমাণু শক্তি থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ ব্যবহারের চল ভারতে খুব বেশি ছিল না। কিন্তু দেশে বিদ্যুতের বিপুল চাহিদা মেটাতে ভারত যে এ বার বিকল্প উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা করছে, নয়াদিল্লির সাম্প্রতিক এই উদ্যোগে তা স্পষ্ট।
রাশিয়ার পরমাণু সংস্থার প্রধান জানিয়েছেন, তারা কল্যাণমূলক কাজেই এই পরমাণু শক্তির ব্যবহার করবেন। ধ্বংসাত্মক কোনও কাজে তারা এই শক্তির ব্যবহার করবেন না।
রাশিয়া দীর্ঘ দিন ধরেই ভারতের বিশ্বাসযোগ্য বন্ধু। স্বাধীনতার পর থেকেই নয়াদিল্লির একাধিক অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক সঙ্কটে নয়াদিল্লির পাশে দাঁড়িয়েছে মস্কো।
এখনও ভারত রাশিয়া থেকেই সবচেয়ে বেশি পরিমাণে সমরাস্ত্র কিনে থাকে। এমনকি রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের আবহে আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়া যখন রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ রেখেছে, তখনও পুতিনের দেশ থেকে অশোধিত তেল কেনা অব্যাহত রেখেছে নয়াদিল্লি।
ভাসমান পরমাণু কেন্দ্র মূলত রাশিয়ারই মস্তিষ্কপ্রসূত। এখনও পর্যন্ত এটি তৈরির কলাকৌশলও একমাত্র রাশিয়াই জানে। নিজেদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে, মোটা টাকার বিনিময়ে রাশিয়া ভারতের হাতে এই কৌশল তুলে দিচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
আবার সম্প্রতি রাশিয়া আমেরিকার বিরুদ্ধে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টার অভিযোগ তোলে। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের এই ‘হৃদ্যতা’র প্রতিফলনও পরমাণু সংক্রান্ত এই বোঝাপড়াকে ত্বরান্বিত করেছে বলে মনে করা হচ্ছে।