ইউক্রেনের সঙ্গে সেই ২০২২ সাল থেকে যুদ্ধ চালাচ্ছে রাশিয়া। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বে বিভাজন দেখা দিয়েছে। আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি, জাপান-সহ বহু দেশ একজোট হয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছে। ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে তারা। সেই যুদ্ধ কি এ বার আরও বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়বে?
সমর বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সেই আলোচনায় আসার আগে ঘটনাগুলি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
সাম্প্রতিক সময়ে, রাশিয়ায় জোড়া হামলার ঘটনা ঘটেছে। প্রথম ঘটনাটি ঘটে দাগিস্তান এলাকায়। কয়েক জন আততায়ী সেখানকার গির্জা এবং ইহুদিদের মন্দিরে হামলা চালায়। গির্জার পাদ্রির গলা নৃশংস ভাবে কেটে ফেলা হয়।
শুধু তা-ই নয়, ইহুদি মন্দিরে হামলা চালিয়ে আগুনও ধরিয়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি এলাকার আরও কয়েকটি জায়গায় হামলা করে আততায়ীরা। এই ঘটনা কি শুধুই ধর্মীয় কারণে, না কি এর নেপথ্যে রয়েছে অন্য কারণ?
এই আবহেই গত রবিবার রুশ অধিকৃত ক্রিমিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইউক্রেন। গত দু’বছর ধরে ইউক্রেন মূলত রুশ আক্রমণ প্রতিহত করে আসছিল। রবিবার রুশ অধিকৃত অঞ্চলে সরাসরি হামলা চালায় তারা।
এই হামলার ঘটনায় অন্তত চার জনের মৃত্যু ঘটেছে বলে খবর। আহত শতাধিক। তার পর থেকেই বৃহত্তর যুদ্ধের আশঙ্কা করছে বিশ্বে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে আর যুদ্ধ সীমাবদ্ধ থাকবে না, ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তেও।
কেন এই আশঙ্কার জন্ম হল? ক্রিমিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছে মস্কো। রাশিয়া মনে করছে এই হামলা ইউক্রেন চালালেও এর নেপথ্যে রয়েছে আমেরিকা। এই হামলার ঘটনার পরই রাশিয়ার আমেরিকান রাষ্ট্রদূতকে তলব করে মস্কো। সূত্রের খবর, সেখানে তাঁকে এই নিয়ে কড়া কথা শোনানো হয়েছে।
ক্রিমিয়ায় হামলা নিয়ে ভ্লামিদির পুতিন সরকার এখনও পর্যন্ত বেশি শব্দ খরচ করেনি। শুধু এক বাক্যে জবাব দিয়ে জানান, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা নিয়ে অবশ্যই প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ করা হবে।
কিন্তু এই হামলার নেপথ্যে আমেরিকা-যোগ কী ভাবে খুঁজে পাচ্ছে রাশিয়া? এই প্রশ্নই এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত কূটনৈতিক মহলে। ক্রিমিয়ায় যে ক্ষেপণাস্ত্র পড়েছে তা হল ‘আর্মি ট্যাকটিক্যাল মিসাইল সিস্টেম (এটিএসিএমএস)’। এই ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি হয় আমেরিকাতেই। অর্থাৎ, ইউক্রেনকে আমেরিকাই এই ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করেছিল।
২০২২ সালে রাশিয়ার হামলার পরই ইউক্রেনের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সামরিক দিক থেকে তো বটেই, অন্যান্য ক্ষেত্রেও সব রকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয় হোয়াইট হাউস।
তবে এত দিন জ়েলেনস্কি সরকার মূলত রুশ হামলা প্রতিহত করছিল। যদি ইউক্রেনের জমিতে ঢুকে রুশ সেনা হামলা করে, তা হলেই পাল্টা জবাব দিচ্ছিল ইউক্রেন সেনা। রাশিয়ায় গিয়ে হামলা চালানো থেকে প্রায় বিরতই ছিল তারা।
কিন্তু রবিবারের হামলার পর বোঝা যাচ্ছে, ইউক্রেন ‘রক্ষণাত্মক’ খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছে। তারাও পাল্টা হামলা চালাচ্ছে। এত দিন ‘চুপ’ থাকার পর কেন আক্রমণের পথে হাঁটল ইউক্রেন, তা নিয়ে চর্চা চলছে।
রাশিয়ার মতে, আমেরিকার মদত পেয়েই ইউক্রেন এই হামলা চালিয়েছে। এর জন্য জি৭ সম্মেলনের মাঝে জ়েলেনস্কি-বাইডেন বৈঠককেই দায়ী করছে রুশ প্রশাসন।
সূত্রের খবর, সেই বৈঠকেই যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে রাশিয়ার যে কোনও জায়গায় আমেরিকান অস্ত্র ব্যবহার করে হামলা চালানোর জন্য ইউক্রেনকে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে আমেরিকা। সেই খবর প্রকাশ্যে আসার পরই শোরগোল পড়ে যায় বিশ্বে।
রবিবারের হামলার পর আমেরিকার এই সবুজ সঙ্কেতকে কাঠগড়ায় তুলছে রাশিয়া। তাদের মতে, ক্রিমিয়ায় যে হেতু আমেরিকান ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার হয়েছে, তাই বলাই যায় আমেরিকার ইশারাতেই ইউক্রেন হামলা করেছে।
একই সঙ্গে দাগিস্তানে আততায়ী হামলার নেপথ্যেও আমেরিকা রয়েছে বলে মনে করছেন রাশিয়া। কেন এই ধারণা? ওই হামলার কিছু ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই সব ভিডিয়োয় আততায়ীদের দেখা গিয়েছে অস্ত্র হাতে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে।
সেই অস্ত্র নিয়েই চলছে আলোচনা। আততায়ীদের হাতে যে বন্দুক দেখা গিয়েছিল, তা সবই আমেরিকায় তৈরি। প্রশ্ন উঠেছে, কী ভাবে আততায়ীরা ওই বন্দুক পেল? কাদের মদতে এই হামলা? রাশিয়া এ ব্যাপারে তেমন প্রতিক্রিয়া না দিলেও ক্রিমিয়া হামলা নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে।
ক্রিমিয়া নিয়ে বিরোধ নতুন নয়। আগে এই এলাকা ইউক্রেনের অংশ ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে রাশিয়া এখানে আক্রমণ করে এবং দখল করে নেয়। তার পর থেকে ক্রিমিয়া রয়েছে রুশের দখলেই।
২০১৪ সালে রাশিয়াকে এই হামলার দাম চোকাতে হয়। জি৮ থেকে বার করে দেওয়া হয় পুতিনের দেশকে। সেই থেকে বিশ্বে জি৭-ই ছড়ি ঘোরাচ্ছে।
সেই ক্রিমিয়ায় নতুন করে ইউক্রেনের হামলা দেখে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন অনেকেই। তাঁদের ধারণা, আমেরিকা এত দিন পরোক্ষ ভাবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে ছিল। এ বার সরাসরি শুরু হতে পারে রাশিয়া-আমেরিকা যুদ্ধ।
হঠাৎ রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকা কেন সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চাইছে? কূটনৈতিক মহলের একাংশের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের উত্তর কোরিয়া এবং ভিয়েতনাম সফর চিন্তায় ফেলেছে বাইডেনকে।
উত্তর কোরিয়া যে আমেরিকার বড় শত্রু তা সকলেরই জানা। সেই উত্তর কোরিয়ায় গিয়ে সে দেশের প্রেসিডেন্ট কিম জং উনের সঙ্গে পুতিনের বৈঠক চুক্তি ভাল চোখে দেখছে না হোয়াইট হাউস।