বিমানে রাখা স্যুটকেসবোমার বিস্ফোরণে উড়ে গিয়েছিল এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ‘কণিষ্ক’। তাতে মারা গিয়েছিলেন শিশু-সহ ৩৩১ জন যাত্রী, বিমানকর্মী। মৃতদের মধ্যে ভারতীয় ছাড়াও ছিলেন বহু ব্রিটিশ এবং কানাডীয় নাগরিক।
সাল ১৯৮৫। সে বছরের জুনে ওই বিস্ফোরণ-কাণ্ডে সাড়া পড়ে গিয়েছিল দেশ-বিদেশে। ওই কাণ্ডের মূল চক্রী হিসাবে অভিযোগ উঠেছিল তলবিন্দর সিংহ পারমারের বিরুদ্ধে।
পারমার ছাড়াও মামলার অন্যতম অভিযুক্তদের তালিকায় নাম উঠেছিল রিপুদমন সিংহ মালিক, ইন্দ্রজিৎ সিংহ রেয়াত এবং আজেইব সিংহ বাগরির। বৃহস্পতিবার সকালে কানাডায় এক ব্যক্তির খুনের পর আবারও শিরোনামে আশির দশকের ওই বিস্ফোরণ-কাণ্ড। কেন?
কানাডীয় পুলিশ ওই নিহতের নাম-পরিচয় প্রকাশ্যে আনেনি। তবে ‘কণিষ্ক’ মামলায় একদা অভিযুক্ত সত্তরোর্ধ্ব ওই ব্যক্তি যে মালিক এবং তাঁকে লক্ষ্য করেই গুলি চালানো হয়েছে বলে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের দাবি। ঘটনাস্থলেই মারা যান মালিক।
পারমার, মালিকেরা আশির দশকে খলিস্তানপন্থী শিখ জঙ্গি সংগঠন ‘বব্বর খালসা’র সদস্য ছিলেন বলে অভিযোগ। এয়ার ইন্ডিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিস্ফোরণ-কাণ্ডে ওই সংগঠনই জড়িত ছিল বলেও দাবি।
তদন্তকারীদের আরও দাবি, ভ্যাঙ্কুভার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মালপত্রের সঙ্গে ওই স্যুটকেসবোমাটি রাখা হয়েছিল। পরে তা টরন্টোতে এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১৮২-তে সেটি চালান করে দেওয়া হয়। এর পর অতলান্তিকের উপর ৩১ হাজার ফুট উঁচুতে তাতে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল। তাতে মাঝআকাশেই মৃত্যু হয় বিমানের সকলের।
এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ১৮২ (বোয়িং ৭৪৭)-টির নাম ‘কণিষ্ক’ হওয়ায় তা ‘কণিষ্ক মামলা’ নামেও পরিচিত। ওই মামলায় মালিক এবং বাগরির বিরুদ্ধে ৩৩১ জনকে খুনের মামলা রুজুর সময় গণহত্যার ধারা জুড়ে দেওয়া হয়েছিল।
পারমারের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে ছিলেন বলেও মালিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ। যদিও ওই মামলার নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই ১৯৯২ সালে পারমারকে খুনের অভিযোগ ওঠে পঞ্জাব পুলিশের বিরুদ্ধে।
‘কণিষ্ক মামলা’র তদন্তকারীদের দাবি ছিল, পঞ্জাবে অসংখ্য হামলার পিছনে হাত ছিল ‘বব্বর খালসা’র। কানাডীয় ইতিহাসের এই ভয়ানকতম বিস্ফোরণ-কাণ্ডেও তারাই দায়ী। এবং মালিক ওই সংগঠনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
২০০৫ সালে প্রমাণাভাবে ওই মামলা থেকে অব্যাহতি পান মালিক। তবে তত দিনে বছর চারেক জেলে কাটিয়ে ফেলেছেন তিনি। এ বার মৃত্যুর পরে আবারও নজরে উঠে এসেছেন মালিক। কে তিনি?
১৯৭২ সাল থেকে কানাডায় বসবাস শুরু করেছিলেন মালিক। সে বছর থেকেই ট্যাক্সিচালক হিসাবে রোজগার করতে থাকেন। পরে ব্যবসায়ী হিসাবেও নাম করেন। ব্যবসার পাশাপাশি কানাডায় বসবাসকারী শিখ সম্প্রদায়ের জন্য খালসা ক্রেডিট ইউনিয়ন (কেসিইউ) নামে এক সংগঠনও খুলেছিলেন মালিক।
ভ্যাঙ্কুভারে ওই সংগঠনের সদস্যসংখ্যা এককালে ১৬ হাজারেরও বেশি ছিল। মালিকের সভাপতিত্বে সংগঠনের সম্পত্তির পরিমাণ বাড়তে থাকে। এক সময় তা ১১ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ভারতীয় মুদ্রায় তা ৮৭৮ কোটি টাকার বেশি।
কানাডার যে প্রদেশে খুন হন মালিক সেই ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় সতনাম এডুকেশন সোস্যাইটিও খুলেছিলেন তিনি। সে দেশে খালসা স্কুলও শুরু করেন। তাতে কানাডীয় পাঠ্যসূচি ছাড়াও পঞ্জাবি ভাষা এবং শিখ সম্প্রদায়ের ইতিহাসও পড়ানোর বন্দোবস্ত রয়েছে।
তদন্তকারীদের দাবি ছিল, পারমারের দুই আত্মীয় মালিকের স্কুলে পড়াশোনা করতেন। সেই সূত্রেই কি মালিকের সঙ্গে পারমারের যোগাযোগ হয়েছিল? তা অবশ্য জানা যায়নি।
‘কণিষ্ক মামলা’ অব্যাহতি পাওয়ার দীর্ঘদিন পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এ দেশে এসেছিলেন মালিক। ঘটনাচক্রে, সেপ্টেম্বরেই বিদেশে বসবাসকারী ৩১২ জন শিখ সম্প্রদায়ভুক্তকে ৩৫ বছরের পুরনো কালো তালিকা থেকে বাদ দিয়েছিল কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। তার মধ্যে ছিলেন মালিকও।
সম্প্রতি দিল্লি, অন্ধ্রপ্রদেশ, পঞ্জাব এবং মহারাষ্ট্রে তীর্থযাত্রায় এ দেশে এসেছিলেন মালিক। সংবাদমাধ্যমে এ তথ্য জানিয়েছেন ইন্ডিয়ান ওয়ার্ল্ড ফোরামের সভাপতি পুনীত সিংহ চন্দোক।
এককালে যাঁর বিরুদ্ধে খলিস্তানপন্থী হওয়ার অভিযোগ উঠেছিল, সেই মালিক সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লিখে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। পঞ্জাবে বিধানসভা নির্বাচনের আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ওই চিঠিতে শিখ সম্প্রদায়ের জন্য মোদীর উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন তিনি।