ক্যানসারকে কব্জা করতে এ বার ন্যানো রোবটকে হাতিয়ার করতে চাইছেন ক্যানসার বিশেষজ্ঞেরা। সম্প্রতি ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা ন্যানো রোবট তৈরি করেছেন যা ইঁদুরের ক্যানসার কোষকে মেরে ফেলতে পারে বলে দাবি করা হয়েছে।
গবেষণাটি নেচারের ‘ন্যানো টেকনোলজি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, রোবটটিকে এমন একটি ক্ষুদ্র আকার দেওয়া হয়েছে যাতে সেটি টিউমারের ভিতরে গিয়ে উন্মুক্ত হয় এবং সুস্থ কোষগুলিকে বাঁচিয়ে রাখে।
ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের গবেষকদের দল এর আগে একটি অ্যামাইনো অ্যাসিডের শৃঙ্খল দিয়ে ষড়ভুজ আকৃতির পেপটাইডের কাঠামো তৈরি করেছিলেন। এই কাঠামোটি কোষের দেওয়ালে আটকে ‘ডেথ রিসেপ্টর’ প্রক্রিয়াটি ডেকে আনতে পারে বলে দাবি গবেষকদের।
যখন কোনও জীবের এক বা একাধিক কোষ সংক্রামিত হয়, তখন কোষের মৃত্যু ঘটে। কোষগুলির স্বাভাবিক বিকাশের জন্য এবং কোষচক্র পরিপূর্ণ হওয়ার জন্য জীবকোষের মৃত্যু প্রয়োজনীয়। কোষের নিয়মিত ক্রিয়াকলাপ বজায় রাখার জন্যেও এটি গুরুত্বপূর্ণ।
পেপটাইডের এই ষড়ভুজাকার ‘ন্যানো প্যাটার্নটি’ একটি প্রাণঘাতী অস্ত্রে পরিণত হয়েছে বলে গবেষণার নেতৃত্বে থাকা ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের মেডিক্যাল বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড বায়োফিজিক্স বিভাগের অধ্যাপক বোজ়র্ন হগবার্গ দাবি করেছেন।
তিনি বলেন, যদি এই পেপটাইডের কাঠামোটিকে ওষুধ হিসাবে ক্যানসার আক্রান্ত দেহে প্রবেশ করানো হয় তবে এটি নির্বিচারে শরীরের কোষগুলিকে হত্যা করতে শুরু করবে, যার ফল মোটেই ভাল হবে না।
এই সমস্যার সমাধান করার জন্য বিজ্ঞানীরা ডিএনএ থেকে তৈরি একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাঠামোর (ন্যানো স্ট্রাকচার) ভিতরে রোবটটি লুকিয়ে রেখেছেন বলে বলা হয়েছে গবেষণায়।
গবেষকদের এই দল বহু বছর ধরে কাজ করে চলেছে। এখন তারা এই ‘অস্ত্র’টিকে সঠিক ভাবে চালানোর কৌশল ব্যবহার করে দেখেছেন যাতে সঠিক পরিস্থিতিতে ন্যানো রোবটটি সক্রিয় করা হয়।
গবেষকেরা জানিয়েছেন, অস্ত্রটি তাঁরা এমন ভাবে লুকিয়ে রাখতে পেরেছেন যে এটি শুধুমাত্র একটি টিউমারের মধ্যে এবং তার আশপাশে পাওয়া পরিবেশেই সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। যার একমাত্র লক্ষ্য হল ক্যানসার আক্রান্ত কোষগুলিকে নিধন করা, কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই।
স্তন ক্যানসারের টিউমার-সহ ন্যানো রোবটটিকে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে একটি ইঁদুরের দেহে প্রবেশ করিয়ে পরীক্ষা করেন গবেষকেরা। অন্য একটি ইঁদুরের দেহে ন্যানো রোবটের একটি নিষ্ক্রিয় সংস্করণ প্রবেশ করানো হয়।
সেই পরীক্ষার যে ফলাফল সামনে এসেছে তাতে এটা স্পষ্ট যে সক্রিয় ন্যানো রোবটটি ইঁদুরের দেহে টিউমারের বৃদ্ধি ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।
তবে এখনই এই গবেষণাকে পুরোপুরি সফল বলতে নারাজ ক্যারোলিনস্কার বিজ্ঞানীরা। ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের মেডিক্যাল বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড বায়োফিজিক্স বিভাগের গবেষক ইয়ং ওয়াং সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, আরও জটিল ক্যানসারের মডেলগুলিতে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে দেখা হবে। বিশেষত মানবদেহের ক্যানসারের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে এমন জটিল ধরনের টিউমারের ওপর আরও নিবিড় পরীক্ষানিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে বলে মত গবেষকদের।
ন্যানো রোবটটির সাফল্যের চাবিকাঠি লুকিয়ে রয়েছে কম পিএইচ বা অম্ল পরিবেশে (অ্যাসিডিক মাইক্রোএনভায়রনমেন্ট)। কারণ ক্যানসারের কোষগুলির আশপাশেই এই ধরনের পরিবেশ থাকে। যা ন্যানো রোবটকে সক্রিয় করে তোলে।
চিকিৎসক-গবেষকদের মতে ন্যানো প্রযুক্তি এমন একটি সম্ভাবনা যা ক্রমশ চিকিৎসা বিপ্লবের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠছে। ন্যানো প্রযুক্তি কী ভাবে জটিল রোগের চিকিৎসাকে আরও সফল এবং সুনির্দিষ্ট করে তুলতে পারে তা নতুন এই গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে। ক্যানসার চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলিকে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করে হ্রাস করা সম্ভব, এমনটাই বলছে গবেষণা।