দিনরাত এক করে ঘাড় গুঁজে কাজ করতে করতে খেয়ালই থাকে না দিনে ঠিক কত ঘণ্টা কাজের মধ্যে পার হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি বহুজাতিক সংস্থার ‘কাজের চাপ’ সহ্য করতে না পেরে ২৬ বছরের তরুণীর মৃত্যুতে বিতর্ক তৈরি হয়েছে দেশ জুড়ে। কেরলবাসী ২৬ বছরের চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অ্যানা সেবাস্টিয়ানের মৃত্যুর পরই দেশ-বিদেশের বহু সংস্থার বিরুদ্ধে একে একে অভিযোগের আঙুল উঠতে শুরু করেছে।
বিভিন্ন সংস্থায় কাজের পরিবেশ থেকে শুরু করে, কাজের সময়সীমা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ জমা পড়তে শুরু করেছে সংবাদমাধ্যম ও সমাজমাধ্যমে। সমাজমাধ্যমে নানা বহুজাতিক সংস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানাচ্ছেন সংস্থারই কর্মীরা।
কর্পোরেট সংস্থাগুলিতে কাজের সময় ঠিক রাখার জন্য বিশেষ আইন তৈরির কথা বলেছেন তাঁরা। কেউ কেউ আবার কড়া শাস্তির দাবি তুলেছেন। অ্যানার মৃত্যু নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসনও। তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রকও।
সংস্থারই কর্মীদের একাংশের দাবি, তাঁদের উপর কাজের চাপ বাড়িয়েই চলেছে সংস্থা। ফলে বাড়ছে কাজ করার সময়। এই কাজের সময় নিয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজ়েশন একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যাতে স্পষ্ট হয়েছে বিশ্বের কোন দেশে কত ঘণ্টা অফিসে কাজ করতে হয় কর্মীদের।
২০২৪ সালের, অর্থাৎ চলতি বছরের পরিসংখ্যানই পেশ করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা। যেখানে গোটা পৃথিবীর দেশগুলির কর্মসময় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কোন দেশে চাকুরিজীবীদের একটানা কত ক্ষণ কাজ করতে হয় তার পূর্ণ তথ্য জানানো হয়েছে এই রিপোর্টে।
রিপোর্টের তালিকায় কত নম্বরে রয়েছে ভারত? এখানে সপ্তাহে কত ক্ষণ কাজ করেন মানুষ, সবই রয়েছে এই রিপোর্টে।
সাপ্তাহিক হিসাব ধরলে ভারতের চাকুরিজীবীরা মোট ৪৬.৭ ঘণ্টা কাজ করে থাকেন। ছ’দিন অফিস হলে রোজ ৭.৭৮ ঘণ্টা। পাঁচ দিন অফিস হলে ৯.৩ ঘণ্টা।
ইংল্যান্ড, আমেরিকা, চিনের কর্মচারীদের তুলনায় এ দেশের প্রতিটি কর্মচারী নির্দিষ্ট সময়ের অনেক বেশি কাজ করছেন। একই অবস্থা পড়শি দেশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের। সপ্তাহে ৪৬ ঘণ্টার বেশি কাজ করে থাকেন এই দুই দেশের কর্মীরাও।
সবচেয়ে কম সময় অফিসে কাটান কিরিবাটির মানুষেরা। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটিতে সপ্তাহে ২৭ ঘণ্টা কাজ করলেই চলে।
চিনের চাকুরিজীবীরা গড়ে সপ্তাহে প্রায় ৪৬.১ ঘণ্টা কাজ করে থাকেন বলে তালিকায় বলা হয়েছে।
ইংল্যান্ড, আমেরিকার সংস্থার কর্মীদের যথাক্রমে সপ্তাহে ৩৫ ও ৩৮ ঘণ্টা কাজ করার নিয়ম।
১৬০টি দেশকে অবশ্য পিছনে ফেলে দিয়েছে ভারতেরই একটি প্রতিবেশী ছোট্ট রাষ্ট্র। অফিসে সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করতে হয় ভুটানের বাসিন্দাদের। সপ্তাহে ৫৪ ঘণ্টারও বেশি সময় সংস্থায় ব্যয় করেন কর্মীরা।
কাছাকাছি রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহিও। কর্মীরা সাপ্তাহিক ৫০ ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন অফিসে।
মেক্সিকোতে শ্রমিকদের সপ্তাহে ৪৩.৭ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। অর্থাৎ, সপ্তাহে ছ’দিন অফিস হলে রোজ ৭.২ ঘণ্টা করে কাজ। পাঁচ দিন অফিস হলে ৮.৭ ঘণ্টা। মেক্সিকোর মতো আলজিরিয়ায় একই সময় বরাদ্দ কর্মীদের। সপ্তাহে মোট ৪৩.৭ ঘণ্টা, ছ’দিন অফিস হলে রোজ ৭.৩৩ ঘণ্টা। পাঁচ দিন অফিস হলে ৮.৮ ঘণ্টা।
তুরস্কে সপ্তাহে মোট ৪৩.৯ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। ছ’দিন অফিস হলে রোজ ৭.৩ ঘণ্টা, পাঁচ দিন অফিস হলে ৮.৭ ঘণ্টা।
অ্যানার করুণ পরিণতির পর অনেকের দাবি, অতিরিক্ত কাজের চাপের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরছেন দেশের বহু বেসরকারি সংস্থার লক্ষ লক্ষ কর্মী। অফিসে ঢোকার সময় নির্ধারিত হলেও বেরোনোর সময়ের কোনও ঠিক থাকে না।
আট ঘণ্টার ‘ডিউটি আওয়ার্স’, সে তো শুধু খাতায়কলমে, বাস্তবে তার প্রয়োগ হয় না বললেই চলে এমনটাই অভিযোগ চাকুরিজীবীদের।
ছোট-বড় যে কোনও সংস্থাতেই কাজের চাপ ক্রমবর্ধমান। কর্মজীবনের এই প্রবল চাপ প্রভাব ফেলছে ব্যক্তিগত ও সাংসারিক জীবনেও।