জানুয়ারিতে দ্বিতীয় বারের মতো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিতে চলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আনুষ্ঠানিক ভাবে কুর্সি দখল করার আগেই ‘ব্রিকস’ দেশগুলির বিরুদ্ধে সুর চড়়াতে শুরু করে দিয়েছেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি, বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ‘ব্রিকস’ রাষ্ট্রগুলির উপর ১০০ শতাংশ আমদানি শুল্ক চাপাবেন তিনি।
ডলারের প্রতিপত্তি কমাতে নতুন মুদ্রা আনার পরিকল্পনা রয়েছে ভারত, রাশিয়া, চিন ও ব্রাজ়িলের মতো ‘ব্রিকস’ দেশগুলির। এই খবর কানে যাওয়ার পর থেকেই ‘ব্রিকস’ দেশগুলিকে ‘শিক্ষা’ দিতে সরাসরি ভাতে মারার পাল্টা কৌশল নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের দণ্ডমুণ্ডের ভাবী কর্তা ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ট্রাম্পের এই শুল্ক যুদ্ধ ঘোষণার কয়েক দিন পরেই ডলার নিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সদ্য বিদায়ী গর্ভনর শক্তিকান্ত দাস। ৬ ডিসেম্বর তিনি জানিয়েছিলেন, এখনই ডলারের প্রতিপত্তি কমানোর পথে (ডি ডলারাইজ়েশন) হাঁটতে চাইছে না ভারত। ডি ডলারাইজ়েশন সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক উদ্বিগ্ন হলেও এখনই এ বিষয়ে চরম সিদ্ধান্ত নিতে নারাজ দেশের শীর্ষ ব্যাঙ্ক। ‘ডি ডলারাইজ়েশন’ নিয়ে মতামত দিতে গিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন, শুধুমাত্র ডলার নির্ভর বাণিজ্য ভবিষ্যতে ভারতের জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে।
ট্রাম্প জেতার পর থেকে ডলার শক্তিশালী হয়েছে। ডলারের নিরিখে টাকার দাম প্রায় ৮৫ টাকায় নেমে গিয়েছে। ফলে ভারত ও জাপানের মতো দেশগুলি থেকে লগ্নি সরাচ্ছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। এর জেরে সংশ্লিষ্ট দেশগুলির শেয়ারের সূচকে বড় পতন লক্ষ করা গিয়েছে।
মূল্যবৃদ্ধি বা মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে এক মুদ্রার উপর নির্ভরতা অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের। তাই ডলার নির্ভরতা কমাতে ও শুল্ক সমস্যার মোকাবিলা করতে ভারতীয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক বিকল্প রাস্তায় হাঁটার পরিকল্পনা করেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে টাকার ব্যবহার আরও বৃদ্ধি করতে ও বাণিজ্যকে ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য কয়েকটি দেশের সঙ্গে চুক্তির পথে হেঁটেছে ভারত।
সম্প্রতি ব্রাজ়িলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা বিশ্ব বাণিজ্যে ডলারের নির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প মুদ্রা তৈরি করার জন্য ব্রিকস দেশগুলির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত নিজের স্পষ্ট অবস্থান এখনও জানায়নি। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের আর্থিক বিশেষজ্ঞেরাও ব্রিকস মুদ্রা চালু করার প্রতিবন্ধকতা নিয়েও মতামত দিয়েছেন।
ইউরোপের দেশগুলির তুলনায় ব্রিকসের দেশগুলির আর্থ সামাজিক পরিস্থিত ও আর্থিক নীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভারত, রাশিয়া, চিন ও ব্রাজ়িলের আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও সমস্যাও আলাদা। তাই ব্রিকস মুদ্রা চালু করতে হলে তার নীতি নির্ধারণে নানা বাধা তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন আর্থিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
এই সঙ্কটের হাত থেকে রেহাই পেতে ভারত আরও একটি বিকল্প পন্থা বেছে নিয়েছে। ডলার ও অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল কমিয়ে সোনা জমানোর পথে হাঁটছে নয়াদিল্লি। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য বলেছে, চলতি বছরে রেকর্ড সোনা মজুত করেছে ভারত। অন্যান্য দেশ, এমনকি চিনের শীর্ষ ব্যাঙ্কের তুলনায়ও সোনা কেনায় অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে ভারত।
আরবিআইয়ের তথ্য বলছে, গত জুন মাসে ৯.৩ টন সোনা কিনেছে ভারত, যা গত দু’বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। চলতি বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতের সোনা কেনার পরিমাণ ছিল ৩৭.১ টন, যা ২০১৩ সালের পর সবচেয়ে বেশি। অক্টোবর মাসে আরবিআই আরও ২৭ টন সোনা জমা করেছে নিজেদের ভাঁড়ারে। মার্চ ২০২৪-এর শেষে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সোনার তহবিল বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২২.৭৩ টনে। ২০২২ সালের মার্চ মাসে যার পরিমাণ ছিল ৭৬০.৪২ টন।
আরবিআই প্রতি বছর নিজেদের বৈদেশিক তহবিলের পরিমাণ প্রকাশ করে। সেই তথ্য অনুযায়ী আরবিআইয়ের বিদেশি মুদ্রা তহবিলের মোট পরিমাণ ৫৫ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে ডলার, পাউন্ড, ইউরোর মোট মিলিত পরিমাণ ৪৮ লক্ষ কোটি টাকা। ৩ লক্ষ ৭৭ হাজার ২৫০ কোটি টাকা মূল্যের সোনা জমা রয়েছে ভারতের তহবিলে।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল জানিয়েছে, চলতি বছরের অক্টোবরে সারা বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি যে পরিমাণ সোনা কিনেছিল তার ৪৮ শতাংশই ছিল ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে রিপোর্টের ভিত্তিতে, জানুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে আরবিআই ৭৭ টন সোনা কিনেছে, যা অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি। সোনা কেনার নিরিখে ভারতের পর রয়েছে তুরস্ক ও পোল্যান্ড।
শীর্ষ ব্যাঙ্কের তথ্য অনুসারে, অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত ভারতের হাতে মোট ৮৫৮.৩ টন সোনা মজুত রয়েছে। সেই জমা সোনার ৫১০.৫ টন রয়েছে মুম্বইয়ের ভল্টে। এ ছাড়া ইংল্যান্ডের কাছে জমা রাখা ১০০ মেট্রিক টন সোনা বিদেশ থেকে ভারতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের মাটির নীচে থাকা ন’টি ভল্টে থাকা সোনা ফিরিয়ে এনেছে ভারত।
ভারত কেন সোনা ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হল? রাশিয়া এবং ইউক্রেন যুদ্ধের আবহে আমেরিকা, ইংল্যান্ড-সহ অনেক দেশই ভ্লাদিমির পুতিনের দেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। যার ফলে বিদেশি ব্যাঙ্কে রাশিয়ার জমা রাখা সম্পদ ‘ক্লোজ়ড’ করে দেওয়া হয়েছে। ভারতও তাই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এমন পদক্ষেপ করেছে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
ডলারের নিরিখে টাকার দাম পড়লেও আন্তর্জাতিক বাজারে টাকার শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। রাশিয়া-সহ বেশ কয়েকটি দেশ ভারতে সরাসরি স্থানীয় মুদ্রায় ব্যবসায়িক লেনদেন চালানোর আগ্রহ দেখিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আবহে রাশিয়ার উপর আমেরিকার আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা সত্ত্বেও রাশিয়া রুবল ও রুপিতে সরাসরি বাণিজ্যে চালিয়ে যাচ্ছে।
সোনা মজুতকে সামনে রেখে স্থানীয় মুদ্রায় আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের সুবিধা পাবে ভারত। বিশেষজ্ঞদের আরও দাবি ডলারের নিরিখে টাকার দর পড়লেও সোনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ব্যবসা চালানোর বিকল্প পথ খোলা রাখবে নয়াদিল্লি।