১৯৯০ সালের ২২ মার্চ। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের একটি অ্যাপার্টমেন্টে পাওয়া গেল বিজ্ঞানী জেরাল্ড ভিনসেন্ট বুলের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ। জেরাল্ড কানাডার নাগরিক। বিশ্বের প্রথম সারির অস্ত্রবিজ্ঞানী। কে বা কারা তাঁকে খুন করল? কেন খুন করল? ঘটনা প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গেই কৌতূহল ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে।
মার্কিন সংবাদপত্র ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর সেই সময়ের রিপোর্ট বলছে, জেরাল্ডের মাথায় এবং পিঠে মোট ৫টি গুলির ক্ষত ছিল। আরও বলা হয়, খুনের সময় জেরাল্ডের দরজায় চাবি ঝুলছিল। তাঁর ব্রিফকেসে রাখা ২০ হাজার ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১৭ লক্ষ টাকা) কেউ ছুঁয়েও দেখেনি।
আরও একটি সূত্র দাবি করে, কলিং বেলের আওয়াজ শুনে জেরাল্ড দরজা খুলতেই তাঁকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে তিন আততায়ী।
কিন্তু কেন খুন হলেন জেরাল্ডের মতো এক জন বিখ্যাত অস্ত্রবিজ্ঞানী তথা জ্যোতির্পদার্থবিদ? কিনারা হয়নি আজও। তবে অনেকের সন্দেহ, ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ খুন করিয়েছিল জেরাল্ডকে। জেরাল্ডের মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে অনেক ‘ভুয়ো’ তথ্যও ইউরোপীয় সংবাদমাধ্যমে ছড়ানো হয় বলে অভিযোগ। কিন্তু কেন? তার ইঙ্গিত রয়েছে জেরাল্ডের কর্মকাণ্ডেই।
ইরাকের একনায়ক শাসক সাদ্দাম হুসেনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন জেরাল্ড। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, নতুন ধরনের মারাত্মক ক্ষমতাশালী অস্ত্র তৈরি করা। ওই সামরিক প্রকল্পের নাম ছিল ‘প্রোজেক্ট ব্যাবিলন’। পরিকল্পনা সফল হলে তা আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠতে পারত ইজরায়েলের কাছে। শুধু ইজরায়েল কেন, সাদ্দাম-জেরাল্ডের ‘স্বপ্নপ্রকল্পে’ দুঃস্বপ্নের মেঘ ঘনিয়েছিল আমেরিকার মনেও। মনে করা হয়, কানাডার ওই অস্ত্রবিজ্ঞানীর সঙ্গে ‘শত্রু’ ইরাকের ঘনিষ্ঠতা ভাল চোখে দেখেনি তেল আভিভ থেকে ওয়াশিংটন কেউই।
ফরাসি সাহিত্যিক জুল ভার্ন তাঁর কল্পবিজ্ঞানের গল্পে অতিকায় এক আগ্নেয়াস্ত্রের কথা লিখেছিলেন। যার মাধ্যমে পৃথিবী থেকে কোনও বস্তুকে ছুড়ে দেওয়া যাবে চাঁদে। তেমন পরিকল্পনাই নেওয়া হল বাস্তবে। ইরাকে বসে করা হয়েছিল এই পরিকল্পনা।
অতিকায় আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির উদাহরণ তার আগেও অবশ্য রয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছুটা আগে জার্মানি তৈরি করেছিল ‘বিগ বার্থা’ নামে এমনই একটি অতিকায় কামান। তা কাজে লাগানো হয়েছিল ওই বিশ্বযুদ্ধে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেই জার্মানিই তৈরি করে ফেলেছিল শ্যয়্যার গুস্তাভ গান। অ্যাডলফ হিটলারের জার্মানির হাতে এমন ‘বন্দুক’-এর সংখ্যা ছিল ২টি।
দু’টি বিশ্বযুদ্ধের পর অস্ত্রপ্রযুক্তি বেশ কয়েকটি লম্বা লাফ দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে। অত্যাধুনিক রকেট, অত্যাধুনিক কামান এসেছে। নানা পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এসেছে। কম্পিউটারের মাধ্যমে নির্ভুল লক্ষ্যে ছুড়ে দেওয়ার ক্ষমতা আয়ত্তে এসেছে। মানুষের ধ্বংসক্ষমতা আরও বেড়েছে।
সাদ্দামের পরিকল্পনা করেন এক মহাবন্দুকের। ‘গান’ নয়, সেটি ‘সুপারগান’। নিজের সেনাবাহিনীর জন্য এমনই অস্ত্রের পরিকল্পনা করেছিলেন ইরাকের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট। সেই অতিকায় আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির প্রকল্পের নামই ছিল ‘প্রোজেক্ট ব্যাবিলন’।
১৯৮৮ সাল নাগাদ, অর্থাৎ কুয়েতে সামরিক অভিযান চালানোর আগে রহস্যময় ‘প্রোজেক্ট ব্যাবিলন’ শুরু করেছিলেন সাদ্দাম। সেই প্রকল্পে জেরাল্ডকে দলে টেনেছিলেন সাদ্দাম। জেরাল্ড মনে করতেন, ওই দৈত্যাকার বন্দুকের মাধ্যমে দূর দেশে গোলা ছোড়ার পাশাপাশি, মহাকাশেও পাঠিয়ে দেওয়া যাবে ২ হাজার কিলোগ্রাম ওজনের কৃত্রিম উপগ্রহ।
এমন কাজে জেরাল্ডের অভিজ্ঞতাও ছিল অনেক। কারণ, বহু দূরে এবং বহু উচ্চতায় নিক্ষেপ করা যায় (হাই অল্ডিটিউড রিসার্চ প্রোজেক্ট) এমন অস্ত্র তৈরিতে হাত পাকিয়েছিলেন জেরাল্ড। তিনি আমেরিকা এবং কানাডা সরকারের একটি যৌথ প্রকল্পে কাজও করেছিলেন এক সময়।
বাগদাদ থেকে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত ব্যাবিলনকে কেন্দ্র করে প্রাচীন কালে তৈরি হয়েছিল উন্নত ব্যাবিলনীয় সভ্যতা। সেই নামেই ওই অস্ত্র তৈরির প্রকল্পের নাম রাখেন সাদ্দাম। তিনি নিজেকে ব্যাবিলন সাম্রাজ্যের সম্রাট নেবুচাদনেজারের বংশধর মনে করতেন।
সাদ্দামের ওই স্বপ্নের প্রকল্প প্রথমে জন্ম দেয় ‘বেবি ব্যাবিলন’ নামে একটি অতিকায় আগ্নেয়াস্ত্রের। যার ব্যারেল ছিল ১৫১ ফুট দীর্ঘ। ব্যারেলের ব্যাস ছিল ৩৫০ মিলিমিটার। ওজন ছিল ১০২ টন। ওই আগ্নেয়াস্ত্রের মাধ্যমে ৭৫০ কিলোমিটার দূরে ছোড়া যেত গোলা। তা থেকে গোলা ছুড়ে পরীক্ষাও করা হয়েছিল। যদিও এই আগ্নেয়াস্ত্র পরীক্ষার পর্বেই ছিল।
এর পর আরও একটি অতিকায় আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বিগ ব্যাবিলন’। যা প্রথমটির থেকে অনেক গুণ বেশি ক্ষমতাশালী হবে। এই আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যারেলের মাপ ৫১২ ফুট হবে বলে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ব্যারেলের ব্যাস হবে ১ মিটার।
এক হাজার কিলোমিটার দূরে গোলা ছুড়তে পারবে ভাবী অস্ত্র, এমনটাই ছিল পরিকল্পনা। আসলে সাদ্দামের লক্ষ্য ছিল, ইজরায়েল এবং মধ্য ইরানকে তাঁর তৈরি আগ্নেয়াস্ত্রের পাল্লায় আনা।
এই পরিকল্পনার জন্য সরঞ্জাম কেনা হয়েছিল ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইটালি ইত্যাদি ইউরোপীয় দেশ থেকে।
শেষ পর্যন্ত সাদ্দামের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কারণ, খুন হয়ে গেলেন তাঁর প্রধান অবলম্বন জেরাল্ড। ১৯৯০ সালের মার্চের পরেই ছেদ পড়ে প্রকল্পে।
দুনিয়ার সামনে প্রাথমিক ভাবে এমন দানবাকৃতি বন্দুক তৈরির পরিকল্পনার কথা অস্বীকার করেছিল ইরাক। কিন্তু, উপসাগরীয় যুদ্ধের পর বাগদাদ তা স্বীকার করে নেয়।
ইরাকের এমন গুপ্ত পরিকল্পনার কথা উঠে এসেছে বলিউডের ছায়াছবিতেও। ‘প্রোজেক্ট ব্যাবিলন’ নিয়ে তৈরি হয় ছায়াছবি ‘ডুমসডে গান’।
সাদ্দামের স্বপ্নের প্রকল্প আছড়ে পড়েছে মাটিতে। তবে ‘প্রোজেক্ট ব্যাবিলন’-এর আওতায় তৈরি হওয়া সেই আগ্নেয়াস্ত্র এবং তার যন্ত্রপাতি এখনও রাখা আছে ব্রিটেনের হ্যাম্পশায়ারের নেলসন দুর্গে। কী ভাবে এ সব ব্রিটেনের হাতে গেল, সে আর এক গল্প।