মনে করা হয়, ওসামা বিন লাদেনকে মারার জন্য যে সামরিক বাহিনীকে আমেরিকার তরফে পাঠানো হয়েছিল, সেই দলে বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি কুকুর ছিল। সে-ই নাকি এই অভিযানে পথ দেখানোর কাজ করেছিল। সেই খবরের জেরে সেই সময় বিশ্ব জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। তবে আমেরিকায় কোনও প্রাণীকে চরবৃত্তির কাজে লাগানোর ইতিহাস আরও পুরনো। আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ চরবৃত্তির কাজে লাগাতে চেয়েছিল বিড়ালকেও। বিড়ালকে গুপ্তচর বানানোর প্রচেষ্টায় কোটি কোটি টাকা খরচও করে আমেরিকা।
সরকারের গুপ্তচর হিসাবে বিড়াল ব্যবহারের ঘটনা কিন্তু একেবারেই রসিকতা নয়। ১৯৬২ সালে কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কটের সময় সাবেক সোভিয়েতদের উপর আড়ি পাততে বিড়ালকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয় আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা।
সিআইএ কর্তাদের মনে হয়েছিল, দোর্দণ্ডপ্রতাপ আমেরিকা যে গুপ্তচর হিসাবে বিড়াল ব্যবহার করবে, সোভিয়েতরা তা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবে না।
সিআইএ কর্তাদের পরিকল্পনা ছিল, বিড়ালের শরীরে শব্দ রেকর্ড করার যন্ত্র লাগিয়ে দেওয়া যাতে সোভিয়েত নেতাদের কাছ ঘুরঘুর করে নানাবিধ তথ্য সংগ্রহ করে আনতে পারে তারা।
বিড়ালকে গুপ্তচর তৈরি করার কথা কার মাথায় প্রথম এসেছিল তা জানা যায় না। তবে এই প্রজেক্টের দায়িত্ব ছিল সিআইএ-এর ‘অফিস অফ টেকনিক্যাল সার্ভিসেস’ এবং ‘অফিস অফ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’-এর উপর।
আটঘাট বেঁধে বিড়ালকে গুপ্তচর বানানোর প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে আমেরিকা। প্রজেক্টের নাম দেওয়া হয় ‘প্রজেক্ট অ্যাকোস্টিক কিটি’।
মনে করা হয়, সঠিক পরিকল্পনা না করেই তা বাস্তবায়িত করার কাজে নামে সিআইএ। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের পরিণতি ছিল ভয়ঙ্কর। তাদের সিদ্ধান্তের যে এ রকম কোনও পরিণতি হবে, তা স্বপ্নেও ভাবনি আমেরিকা। সেই অভিজ্ঞতাই পরে ভাগ করে নিয়েছিলেন সিআইএ-এর প্রাক্তন কর্তা ভিক্টর মার্চেটি।
ভিক্টর জানান, প্রথমে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটি বিড়ালকে বেছে নেন তাঁরা। পরীক্ষা চালানোর জন্য বেছে নেওয়া হয় আরও কিছু বিড়ালকে। ওই বিড়ালগুলি কোনও অস্বাভাবিক আচরণ করছে কি না তা বিশেষ ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হত। ভালমন্দ খাবারদাবারও দেওয়া হয় ওই বিড়ালগুলিকে।
এর পর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাঁরা ওই বিড়ালগুলির মধ্যে একটি করে ব্যাটারি লাগিয়ে দেন। আরও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয় ওই বিড়ালগুলির উপর।
‘প্রজেক্ট অ্যাকোস্টিক কিটি’-র উপর প্রায় পাঁচ বছর ধরে কাজ করে সিআইএ। এই পাঁচ বছরের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের শব্দ রেকর্ড করার যন্ত্র লাগিয়েও পরীক্ষা চলে বিড়ালগুলির উপর।
প্রাথমিক ভাবে দেখা যায়, বিড়ালগুলির উপর ট্রান্সমিটার, মাইক্রোফোন বা অ্যান্টেনা, যে যন্ত্রই লাগানো হচ্ছে, তা-ই তারা নখ দিয়ে ঘষে বা দাঁত দিয়ে নষ্ট করে ফেলছে। গবেষকরা মনে করেন, ওই যন্ত্রগুলি বিড়ালগুলির অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলেই তারা এ রকম আচরণ করছে।
অনেক ভেবে গবেষকরা ঠিক করেন, এমন কোনও যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে যার তাপমাত্রা বিড়ালগুলির শরীরের তাপমাত্রার সঙ্গে মানানসই হবে।
অনেক পরীক্ষা করে বিড়ালের খুলির পিছনে লাগানোর জন্য একটি ৩-৪ ইঞ্চি লম্বা ট্রান্সমিটার তৈরি করা হয়। সেই ট্রান্সমিটার এবং একটি মাইক্রোফোন লাগানোর জন্য খুলির পিছনে একটি সঠিক জায়গা খুঁজতে শুরু করেন বিজ্ঞানীরা।
অবশেষে লাগানো হয় সেই ট্রান্সমিটার। বিড়ালের লোমে অ্যান্টেনার সূক্ষ্ম তার ঢেকে দেওয়া হয়। কিন্তু বড় ব্যাটারি নিয়ে সমস্যা দেখা দেওয়ায় তা খুলে লাগানো হয় অপেক্ষাকৃত ছোট একটি ব্যাটারি।
এর পর ওই গবেষকরা গুপ্তচর বানানোর জন্য বেছে রাখা বিড়ালটির উপর অস্ত্রোপচার করেন।
বিড়ালটির জ্ঞান ফেরার পর তার আচরণে অস্বাভাবিকতা লক্ষ করা যায়। গবেষকরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি শুরু করেন, তাঁরা কোনও ভুল করে বসেননি তো?
বিড়ালটির অবস্থার একটু উন্নতি হলে দেখা যায় যে, খাবার নিয়েও তার ব্যবহারে পরিবর্তন এসেছে। খিদে পেলে বিড়ালটির ব্যবহারে পরিবর্তন লক্ষ করেন গবেষকরা। আবার অস্ত্রোপচার করে সমাধান করা হয় সেই সমস্যার।
সমস্যা মেটানোর পর সিআইএ কর্তারা দেখেন তাঁদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিড়াল গুপ্তচরবৃত্তি করতে মোটামুটি ভাবে তৈরি। তবে তত দিনে ওই প্রজেক্টের পিছনে ১৬৫ কোটি টাকা খরচ করে ফেলেছে আমেরিকা।
সিআইএ কর্তারা ঠিক করেন ওই ‘গুপ্তচর’ বিড়ালের দক্ষতা বুঝতে তাকে ল্যাব থেকে বার করে বাস্তবের দুনিয়ায় নিয়ে যাওয়া হবে।
বিড়াল কতটা গুপ্তচর হয়ে উঠেছে, তা দেখতে তাকে প্রথম দিন একটি পার্কে নিয়ে যাওয়া হবে বলে ঠিক করা হয়। সিআইএর কাছে খবর ছিল যে, ওই পার্কের একটি বেঞ্চে দু’জন গুপ্তচরের একটি গোপন বৈঠক করার কথা। আর তাদের উপর নজরদারি চালাতেই পাঠানো হচ্ছিল বিড়ালটিকে।
তবে প্রথম দিনই বিপর্যয় নেমে আসে আমেরিকার কোটি কোটি টাকার প্রজেক্টে। বিড়ালটি সিআইএর ভ্যান থেকে নেমে রাস্তা পেরিয়ে পার্কে যাওয়ার সময় দ্রুত গতিতে আসা একটি গাড়ি তাকে ধাক্কা মারে। রাস্তাতেই মৃত্যু হয় আমেরিকার গুপ্তচর বিড়ালের।
বিড়ালের মৃত্যুর পর সিআইএ আধিকারিকরা গিয়ে রাস্তা থেকে ওই বিড়ালের দেহাবশেষ তুলে নিয়ে আসেন। তাঁদের ভয় ছিল এই বিড়ালের মৃতদেহ অন্য কারও হাতে পড়লে অনেক তথ্য শত্রু দেশের হাতে চলে যেতে পারে।
বিড়ালটির মৃত্যুর পর ১৯৬৭ সালে ‘প্রজেক্ট অ্যাকোস্টিক কিটি’ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সিআইএ। সিআইএ কর্তারা এ-ও মেনে নেন যে এই প্রজেক্টকে বাস্তবায়িত করার সিদ্ধান্তই ভুল ছিল।