বক্স অফিসে উঠেছে পাঠান ‘ঝড়’। শুধু দেশে নয়, বিদেশের বক্স অফিসেও সাড়া ফেলেছে এই ছবি । মুক্তির প্রথম সপ্তাহেই ‘পাঠান’ সারা বিশ্বে ৬০০ কোটির ব্যবসা করে ফেলেছে। ৮ দিনে ‘পাঠান’-এর মোট আয় ৬৩৪ কোটি টাকা। কিন্তু কী ভাবে চার বছর পর পর্দায় ফিরেই পর্দায় ‘আগুন’ ঝরালেন শাহরুখ? ‘পাঠান’-এ সাফল্যের রহস্য লুকিয়ে রয়েছে কোথায়?
শাহরুখ খান, দীপিকা পাড়ুকোন, জন আব্রাহাম অভিনীত এবং সিদ্ধার্থ আনন্দ পরিচালিত ‘পাঠান’ মুক্তির প্রথম দিনেই বিশ্বব্যাপী ১০৬ কোটি টাকার ব্যবসা করেছিল। তখনই আন্দাজ করা গিয়েছিল এই ছবি বলিউডের ‘লম্বা রেসের ঘোড়া’ হতে চলেছে।
যে কয়েকটি কারণে পাঠান বক্স অফিসের অন্যতম হিট ছবির তকমা পেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম—চার বছর পর শাহরুখের বড় পর্দায় প্রত্যাবর্তন। এর আগে ২০১৮ সালে মুক্তি পেয়েছিল শাহরুখের ‘জ়িরো’। কিন্তু সেই ছবি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে।
তার পর চার বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষা। বলিউডের ‘বাদশা’-র ছবি কবে আবার প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে, তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন অনুরাগীরা। সেই কারণেই পাঠান মুক্তি পেতেই উপচে পড়া ভিড় দেখছে সিনেমা হলগুলি। দেশ জুড়ে পাঠান-এর শো-এর সময় হাততালির ঝড় উঠছে প্রেক্ষাগৃহগুলিতে।
গত বছর মাদক-মামলায় ছেলে আরিয়ান খানের গ্রেফতারির পর থেকে শাহরুখকে নিয়ে জোর চর্চা এবং বিতর্ক তৈরি হয়। সেই সময়ে কোনও ছবির কাজে হাত লাগাতে পারেননি তিনি। এমন কথাও রটেছিল যে, ছেলে আরিয়ানই শাহরুখের কেরিয়ারের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতেছে।
কিন্তু আরিয়ান বেকসুর খালাস পাওয়ার পর আবার ছবির কাজে মন দেন শাহরুখ। নিন্দকদের মুখ বন্ধ করে ‘পাঠান’, ‘জওয়ান’ এবং ‘ডাঙ্কি’-র মতো একের পর এক ছবির কাজ শুরু করেন। এদের মধ্যে ‘পাঠান’ মুক্তি পেলেও বাকি দুই ছবি মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
এই প্রসঙ্গে যশরাজ ফিল্মসের সিইও অক্ষয় উইধানি বলেছেন, “ভারতীয়দের মধ্যে পাঠানের মুক্তি নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছে। বিশ্ববাসীর মধ্যে এই ছবি নিয়ে উন্মাদনা প্রত্যক্ষ করা আমাদের জন্য সত্যিই আনন্দের।’’
হিন্দি, তামিল এবং তেলুগু ভাষায় ২৫ জানুয়ারি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ‘পাঠান’। তার পর থেকে আর এই ছবিকে আটকে রাখা যায়নি। ‘পাঠান-ঝড়’ ওঠার অন্যতম কারণ হিসাবে বিশ্ব জুড়ে এই ছবি মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্তকেও দেখছেন ছবি বিশেষজ্ঞরা।
ভারতে ‘পাঠান’ মুক্তি পেয়েছে সাড়ে ৫ হাজার পর্দায়। ভারত ছাড়াও মোট ১০০টি দেশে মুক্তি পেয়েছে ‘পাঠান’। দেশের বাইরে ২৫০০টি পর্দায় এই ছবি দেখানো হচ্ছে। যার মধ্যে শুধু মাত্র আমেরিকাতেই ৬৯৪টি সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে পাঠান।
উত্তর আমেরিকার বক্স অফিসে হিন্দি ছবি হিসাবে ‘পাঠান’-এর প্রথম দিনের আয় সর্বোচ্চ। ছবিটি মুক্তির দিনেই ১৮ লক্ষ ৬০ হাজার ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ১৫ কোটি টাকা) আয় করেছে আমেরিকায়।
উত্তর আমেরিকার ৬৯৪টি সিনেমা হলে সাম্প্রতিক কালে মুক্তিপ্রাপ্ত যে কোনও ছবির তুলনায় ‘পাঠান’-এর গড় আয় সবচেয়ে বেশি। আয়ের গড় হিসাবে হলিউডকেও টেক্কা দিচ্ছে শাহরুখ-দীপিকার এই ছবি।
‘পাঠান’-এর বাণিজ্যিক সাফল্যের নেপথ্যে ছবির নির্মাতাদের বিপণন কৌশল বা ‘মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি’কেও কৃতিত্ব দিয়েছেন অনেকে। ছবি বিশেষজ্ঞদের দাবি, ‘পাঠান’-এ শাহরুখ-দীপিকা-জনের অভিনয় এবং দুর্দান্ত চরিত্রের পাশাপাশি, প্রযোজকরাও পর্দার পিছনে থেকে দারুণ কাজ করেছেন।
টিজ়ার এবং ট্রেলার মুক্তির সময় থেকেই দর্শকদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ‘পাঠান-দর্শন’ আনন্দের হতে চলেছে। তাই বাছাই দৃশ্য এবং সংলাপ দিয়ে এই টিঁজ়ার এবং ট্রেলার তৈরি করা হয়েছিল। ছবির সংলাপ, স্টান্ট এবং শ্বাসরুদ্ধকর অ্যাকশন দৃশ্যকেও তাই এই ছবির সাফল্যের জন্য বাহবা দিচ্ছেন কেউ কেউ।
আরও একটি কারণের জন্য ‘পাঠান’ সফল হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। তা হল, এই ছবির ‘বেশরম রং’ গান ইউটিউবে মুক্তির দিন থেকেই তৈরি হওয়া বিতর্ক।
একাধিক হিন্দু সংগঠন এবং বিজেপি নেতা-মন্ত্রী এই গানের ভিডিয়ো ‘অশ্লীল’ এবং ভারতীয় সংস্কৃতির ‘পরিপন্থী’ বলে মন্তব্য করে ‘পাঠান’ বয়কটের ডাক দেয়।
দীপিকা পাড়ুকোনকে এই ভিডিয়োতে গেরুয়া রঙের বিকিনি পরিহিত অবস্থায় দেখা গিয়েছিল। যা দেশ জুড়ে আলোড়ন তৈরি করে। কয়েকটি হিন্দু সংগঠনের দাবি ছিল গেরুয়া ধর্মীয় পোশাকের রং। তাই এই দৃশ্য হিন্দুদের সংবেদনশীলতাকে আঘাত করে বলেও ছবি বয়কটের ডাক দেওয়া হয়। তড়িঘড়ি ছবি থেকে সেই দৃশ্যগুলি ছেঁটেও বিশেষ লাভ হয়নি। হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা বয়কটের দাবি থেকে পিছু হটেননি।
‘বয়কট গ্যাং’য়ের দাবিতে মুক্তির আগে আগে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ‘পাঠান’-এর পোস্টার পোড়ানোর ছবিও প্রকাশ্যে আসে। মুক্তির দিনও ভারতের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহের বাইরে একই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি হয়েছিল। বলা হয়, ‘নেগেটিভ পাবলিসিটি ইজ় স্টিল পাবলিসিটি’।
ছবি বিশেষজ্ঞদের মতে ‘পাঠান’ নিয়ে তৈরি হওয়া এই সব বিতর্কই ছবির সাফল্যে ইন্ধন জুগিয়েছে। ছবিতে বিতর্কের মতো কী আছে? তা দেখতেও সিনেমা হলগুলিতে ভিড় জমাচ্ছেন বহু শাহরুখ-বিরাগীও।
‘পাঠান’ ছবির মাধ্যমে ‘স্পাই ইউনিভার্স’ বা ‘গুপ্তচর ব্রহ্মাণ্ডের’ ধারণা নিয়ে এসেছেন যশ রাজ ফিল্মস। সর্বোপরি ছবির সাফল্যের জন্য সেই কারণকেও দেওয়া হয়েছে বিশেষ কৃতিত্ব।
ছবিতে শাহরুখ ‘পাঠান’ খানের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে লড়াই করতে দেখা গিয়েছে সলমন ‘টাইগার’ খানকে। আর সেই দৃশ্য দেখে প্রেক্ষাগৃহগুলি হাততালি এবং শিসের আওয়াজে ফেটে পড়েছে। শুধু হাততালি পাওয়ার জন্য নয়, স্পাই ইউনিভার্সের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্যও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এই দৃশ্য।
মার্ভেল-এর ‘সুপারহিরো ইউনিভার্স’-এর মতোই ‘স্পাই ইউনিভার্স’ বানাচ্ছে প্রযোজনা সংস্থা যশরাজ ফিল্মস। আর তার সূত্রপাত হল ‘পাঠান’ দিয়ে। যশরাজের স্পাই ইউনিভার্সের সূচনা ২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া ছবি ‘এক থা টাইগার’ থেকে। যদিও গুপ্তচরদের নিয়ে আলাদা সিনেমাজগৎ তৈরির কথা তখনও ভাবতে শুরু করেনি যশরাজ।
যশরাজের ‘গুপ্তচর ব্রহ্মাণ্ডের’ প্রধান গুপ্তচর তিন জন। ‘পাঠান’, ‘টাইগার’ ছাড়াও রয়েছে ‘কবির’। পুরো নাম কবির ধালিওয়াল। কবিরের চরিত্রটি দর্শক আগেই দেখেছে। ২০১৯ সালে মুক্তি পেয়েছিল সিদ্ধার্থ আনন্দ পরিচালিত ‘ওয়ার’। সেই সিনেমায় প্রথম প্রকাশ্যে আসে কবির চরিত্র। অভিনয় করেছিলেন হৃতিক রোশন।