কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনেক প্রেম কাহিনিই তৈরি হয়। তেমন অনেক গল্পেরই বাস্তব জীবনে মধুরেণ সমাপয়েৎ ঘটে। আবার কিছু কিছু প্রেমকাহিনি তিক্ততার স্বাদে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তেমনই এক প্রেমের উপাখ্যান রয়েছে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে। যা এক রক্তাক্ত কাহিনি।
আইন নিয়ে পড়াশোনার জন্য দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন প্রিয়দর্শিনী মাট্টু। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর এক সিনিয়রের নজরে (বলা ভাল, কুনজর) পড়েছিলেন এই তরুণী। পরিণতি হয়েছিল ভয়ঙ্কর। ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল প্রিয়দর্শনীকে। সেই রক্তাক্ত কাহিনিই তুলে ধরা হল এই প্রতিবেদনে।
১৯৭০ সালের ২৩ জুলাই জন্ম প্রিয়দর্শিনীর। জম্মু ও কাশ্মীরের শ্রীনগরে বাড়ি তাঁর। প্রিয়দর্শিনী ছিলেন কাশ্মীরি পণ্ডিত।
শ্রীনগরে ‘প্রেজ়েন্টেশন কনভেন্স স্কুলে’ পড়াশোনা করেছিলেন প্রিয়দর্শিনী। জঙ্গি অনুপ্রবেশ ঘিরে কাশ্মীরে অশান্তির কারণে পরে পরিবারের সঙ্গে জম্মুতে চলে গিয়েছিলেন তিনি।
জম্মুর এমএএম কলেজ থেকে বিকম পাশ করেন প্রিয়দর্শিনী। এর পরই এলএলবি ডিগ্রির জন্য পাড়ি দেন দিল্লি। ভর্তি হন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়তে গিয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় প্রিয়দর্শিনীকে। তাঁর প্রেমে আচ্ছন্ন হন তাঁরই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র সন্তোষকুমার সিংহ।
প্রিয়দর্শিনীকে সেই সময় কুপ্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল সন্তোষের বিরুদ্ধে। এমনকি, একটা সময় প্রায়শই প্রিয়দর্শিনীর পিছু নিতেন বলেও অভিযোগ উঠেছিল।
দীর্ঘ দিন সন্তোষের এই হেনস্থার পর পুলিশের দ্বারস্থ হন প্রিয়দর্শিনী। সাল ১৯৯৫। সে বছর সন্তোষের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেন ওই তরুণী।
সন্তোষের পরিবার ছিল প্রভাবশালী। সেই সময় তাঁর বাবা ছিলেন পুদুচেরীর আইজি জে পি সিংহ। ফলে প্রিয়দর্শিনীর অভিযোগ ঘিরে পুলিশ মহলে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল।
অভিযোগ পাওয়ার পর প্রিয়দর্শিনীকে সেই সময় ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাবা পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তা হওয়ায় প্রিয়দর্শিনীর অভিযোগে কোনও ভ্রুক্ষেপ ছিল না সন্তোষের। তাই থানায় তাঁর নামে অভিযোগ দায়েরের পরও প্রিয়দর্শিনীর পিছু ছাড়েননি ওই যুবক।
প্রিয়দর্শিনীর অভিযোগের বদলা নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান সন্তোষ। এক সঙ্গে ২টি ডিগ্রি নিয়ে পড়াশোনা করছেন প্রিয়দর্শিনী— এমনই অভিযোগ করেছিলেন সন্তোষ।
আদতে প্রিয়দর্শিনীকে হেনস্থা করতেই সন্তোষ ওই অভিযোগ করেন বলে জানা গিয়েছিল। কারণ, ১৯৯১ সালে এমকম পাশ করেছিলেন প্রিয়দর্শিনী।
এর পরই ঘটে সেই ভয়ঙ্কর কাণ্ড। সেই সময় দিল্লির বসন্তকুঞ্জে এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকতেন প্রিয়দর্শিনী। সেখান থেকেই তাঁর দেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। তখন ১৯৯৬ সাল।
সে বছরের ২৩ জানুয়ারি সকালে বসন্তকুঞ্জে প্রিয়দর্শিনীর বাড়িতে গিয়েছিলেন সন্তোষ। এমনই দাবি করেছিলেন প্রিয়দর্শিনীর আত্মীয়ের পরিবারের পরিচারক। সন্তোষের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করেছিলেন প্রিয়দর্শিনী, তার রফা করতেই সেখানে তিনি গিয়েছিলেন বলে দাবি করা হয়।
সে দিনই প্রিয়দর্শিনীকে সন্তোষ খুন করেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। প্রথমে প্রিয়দর্শিনীকে ধর্ষণ করা হয়। তার পর বিদ্যুতের তার দিয়ে তাঁকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়। এখানেই থামেননি খুনি। প্রিয়দর্শিনীর মৃত্যুর পর তাঁর মুখে বাইকের হেলমেট দিয়ে ১৪ বার আঘাত করেন সন্তোষ। সেই সময় প্রিয়দর্শিনীর বয়স ছিল ২৫।
মৃত্যুর পর প্রিয়দর্শিনীকে যাতে চিনতে না পারা যায়, সে কারণেই হেলমেট দিয়ে তাঁর মুখে আঘাত করেছিলেন সন্তোষ, এমনটাই জানতে পেরেছিলেন তদন্তকারীরা।
প্রিয়দর্শিনীকে হত্যার ঘটনায় প্রথম থেকেই সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন সন্তোষ। সেই মতো তাঁকে পাকড়াও করে পুলিশ। প্রথমে এই ঘটনার তদন্ত শুরু করেছিল দিল্লি পুলিশ।
পরে সন্তোষের বাবার প্রভাবশালী তকমার জেরে এই ঘটনার তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি ওঠে। প্রিয়দর্শিনীর হত্যার ২ দিনের মধ্যেই তদন্তভার নেয় সিবিআই।
২০০৬ সালের ১৭ অক্টোবর সন্তোষকে দোষী সাব্যস্ত করে দিল্লি হাই কোর্ট। এর আগে, ২০০৪ সালে বিয়ে করেন সন্তোষ। তত দিনে দিল্লিতে ওকালতি শুরু করেছেন তিনি।
সিবিআইয়ের আর্জি মেনে ২০০৬ সালের ৩০ অক্টোবর সন্তোষকে মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেয় আদালত। এই নির্দেশের বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন সন্তোষ। সেটা ২০০৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। এর পর ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে সন্তোষের মৃত্যুদণ্ডের সাজার বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত।