২০০৮ সালে স্পেনের সেভিলে সমাধিটি আবিষ্কার করেছিলেন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। সমাধিতে কঙ্কালের সঙ্গে ছিল হাতির দাঁত, হাতির দাঁতের তৈরি চিরুনি, স্ফটিকের কুঠার, অস্ট্রিচের ডিমের খোলস, পাথরের কুঠার। তা থেকে গবেষকরা মনে করেছিলেন, সমাধিটি গুরুত্বপূর্ণ কোনও নেতার। পরে সেই ধারণা সম্পূর্ণ বদলে যায়। সাহায্য করেছিল নতুন এক পদ্ধতি।
হাড় পরীক্ষা করে গবেষকেরা জানিয়েছিলেন, সেগুলি কোনও পুরুষের, যার বয়স ১৭ থেকে ২৫ বছর। হাড়গুলির বয়স প্রায় ৫,০০০ বছর। ইউরোপীয় প্রত্নতত্ত্ববিদেরা ওই ব্যক্তির নাম দেন ‘আইভরি মানব’ (আইভরি ম্যান)।
এক দশকেরও বেশি সময় পর ওই হাড়গুলি আবার পরীক্ষা করে চমকে যান প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। তাঁরা দেখেন, সেগুলি কোনও পুরুষের নয়, বরং এক মহিলার। ২০২১ সালে নতুন এক পদ্ধতি মেনেই সেই তথ্য আবিষ্কার করা হয়েছিল। তার পরেই অতীত-ইতিহাসের অনেক বিষয় প্রকাশ্যে আসে।
সেভিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লিওনার্দো গার্সিয়া সানজুয়ান ছিলেন ওই গবেষক দলে। তিনি জানান, তাঁরা ধারণাই করতে পারেননি যে ওই কঙ্কাল কোনও মহিলার। যখন পরীক্ষার মাধ্যমে তা জানতে পেরেছিলেন, তখন রীতিমতো হতবাক হন।
লিওনার্দো জানিয়েছেন, ওই আবিষ্কারের পরেই ওই মহিলা এবং সেই আমলে সমাজ সম্পর্কে ইতিহাসবিদদের ধারণা বদলে যায়। তিনি জানিয়েছেন, আগে কোনও কঙ্কালের সঙ্গে ধারালো অস্ত্র মিললে ধরে নেওয়া হত, সেটি কোনও পুরুষের। নতুন এই আবিষ্কারের পর সেই ধারণাতেই ধাক্কা লাগে। লিঙ্গবৈষম্যের গোড়াতেও আঘাত করেছিল সেই আবিষ্কার।
হাড়ের মাধ্যমে লিঙ্গ জানার নতুন উপায়টি প্রথম বার ব্যবহার করা হয় ২০১৭ সালে। কঙ্কালের দাঁতের এনামেল পরীক্ষা করে লিঙ্গ নির্ধারণ করেছিলেন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। ওই এনামেলে পেপটাইড-সহ এক ধরনের প্রোটিন থাকে, যা দিয়ে বোঝা যায়, কঙ্কালটি পুরুষ না কি মহিলার।
কঙ্কালের সামনে উপর এবং নীচের পাটির আটটি দাঁত এবং পেষক (কশের) দাঁত পরীক্ষা করে তাতে অ্যামেলএক্স জিন মিলেছিল। ওই জিন অ্যামেলোজেনিন উৎপাদন করে, যা এক্স ক্রোমোজ়োমে থাকে। এর থেকেই গবেষকেরা বুঝতে পারেন, ওই কঙ্কাল আসলে এক মহিলার।
এর আগে পর্যন্ত কঙ্কালের পেলভিস দেখে সাধারণত তার লিঙ্গ নির্ধারণ করা হত। মহিলাদের পেলভিস পুরুষদের থেকে অনেক চওড়া হয়। হিপ বোন সরু হয়। সেভিলের সমাধি থেকে মেলা ওই কঙ্কালের এ সব অংশ দেখে গবেষকেরা মনে করেছিলেন, সেটি কোনও পুরুষের। সঙ্গে কুঠার থাকায় নিজেদের ধারণার বিষয়ে নিশ্চিতও হয়েছিলেন।
পরবর্তী কালে গবেষকেরা কঙ্কালের লিঙ্গ নিয়ে ভিন্ন দাবি করেন। তাঁরা জানিয়েছেন, সেভিলের ওই কঙ্কালের বয়স ৫,০০০ বছর হওয়ার তার অনেক অংশই ক্ষয়ে গিয়েছিল। ফলে পূর্বতন গবেষকেরা তার লিঙ্গ সঠিক ভাবে নির্ধারণ করতে পারেননি।
কঙ্কালের ডিএনএ পরীক্ষা করেও তার লিঙ্গ নির্ধারণ করা যায়। কিন্তু সেভিলের ওই কঙ্কাল এতটাই পুরনো, যে তার ক্ষয়ে যাওয়া হাড় থেকে ডিএনএ-ও ঠিক মতো সংগ্রহ করা যায়নি। গরম জায়গায় এই ডিএনএ সংগ্রহ করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
সেভিলের ওই কঙ্কালের লিঙ্গ আবিষ্কারের পর গবেষকদের অনেক ধারণাই বদলে যায়। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা মনে করেন, ওই মহিলা সমাজে উঁচু কোনও পদে ছিলেন। যথেষ্ট সম্মান এবং প্রতিপত্তি ছিল তাঁর।
মহিলার সমাধির পাশে অন্তত ডজন খানেক সমাধি ছিল। পরবর্তী ২০০ বছর ধরে সেগুলি গড়ে উঠেছে। রেডিয়োকার্বন ডেটিং করে প্রমাণ পেয়েছেন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। আর তা থেকেই তাঁদের ধারণা, মৃত্যুর পরেও প্রায় ২০০ বছর ধরে সমাজে পূজিত হয়েছেন ওই মহিলা।
প্রত্নতত্ত্ববিদেরা মনে করেন, মহিলার সমাধিতে যে স্ফটিকের কুঠার ছিল, তা পরে সেখানে রাখা হয়েছিল। অত দামি জিনিস আশপাশের আর কোনও সমাধিতে ছিল না।
স্পেন এবং পর্তুগাল থেকে প্রায় ২০০০ প্রাচীন সমাধি মিলেছিল। সে সব সমাধিতে এত দামি জিনিস মেলেনি, যা সেভিলের ওই মহিলার সমাধি থেকে মিলেছে। এমনকি, ওই সময়ের কোনও পুরুষের সমাধি থেকেও অত দামি জিনিস উদ্ধার হয়নি।
গবেষণা বলছে, সেভিলের ওই মহিলার সমাধি তাম্র যুগের। এই সমাধি খতিয়ে দেখে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা মনে করছেন, সে সময় সমাজকে নেতৃত্ব দিতে পারতেন মহিলারা। প্রসঙ্গত, ওই সময় থেকেই ইউরোপে শ্রেণিবিভক্ত সমাজের উদ্ভব হয়।
সেভিলের ওই অভিজাত সমাধিস্থলে কোনও শিশুর সমাধি মেলেনি। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা তাই মনে করেন, তখনও ক্ষমতা বংশানুক্রমিক ভাবে হস্তান্তরিত হত না। নিজেকে অর্জন করে নিতে হত। কোনও নেতার উত্তরাধিকারী তাই একই রকম সম্মান পেতেন না।
অধ্যাপক লিওনার্দো জানিয়েছেন, ওই মহিলাও নিজে ক্ষমতা আদায় করে নিয়েছিলেন। বংশানুক্রমিক ভাবে তা হাতে পাননি। তাঁর সঙ্গে সুদূর সভ্যতার মানুষজনের যোগাযোগ ছিল বলেও মনে করেন তিনি। মহিলার হাড় পরীক্ষা করে তাতে মার্কারি মিলেছে। সিনাবারের মতো খনিজ পোড়ালে এ রকম হয়। গবেষকেরা মনে করতেন, সিনাবার পুড়িয়ে নেশা করা হত সে সময়।
তবে অনেক গবেষকই মনে করেন, মহিলার সমাধি থেকে সে সময়ের সমাজ নিয়ে পুরোপুরি ধারণা করে নেওয়া ঠিক হবে না। অধ্যাপক-গবেষক রেবেকা গোল্যান্ড জানিয়েছেন, মহিলাদের সে সময় অনেক বেশি সম্মান ছিল, তা ভাবাও ঠিক হবে না। ওই মহিলা বিশেষ কোনও সম্মানের অধিকারী ছিলেন, যার নেপথ্যে লিঙ্গের কোনও ভূমিকা ছিল না। এমনও হতে পারে, সে সময় লিঙ্গভেদই হয়তো ছিল না। দুই লিঙ্গের মধ্যে সে ভাবে ফারাক করা হত না। তবে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এটুকু নিশ্চিত যে, সেভিলের ওই কঙ্কালটি এক মহিলার। তবে তিনি কী ছিলেন, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েই যাচ্ছে।