এক সময় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক ছিলেন। বিলাসবহুল জীবনযাপন এবং দুবাইয়ের বিখ্যাত বহুতল বুর্জ খলিফায় বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাটের মালিক হওয়ার সুবাদে থাকতেন চর্চায়। কিন্তু সেই ব্যবসায়ীকেই ১২,৪৭৮ কোটির সংস্থা বিক্রি করতে হয় মাত্র ৭৪ টাকায়।
কথা হচ্ছে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী বিআর শেট্টিকে নিয়ে। জীবনে উত্থান যেমন দেখেছেন এই ব্যবসায়ী, তেমন পতনও দেখেছেন। এক সময় মনে করা হত ‘শেট্টি সাম্রাজ্য’ অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু আর্থিক ভুল এবং ধারাবাহিক বিতর্কের কারণে তাঁর ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে। মাত্র ৭৪ টাকার বিনিময়ে ১২,৪৭৮ কোটি টাকার ব্যবসা বিক্রি করতে বাধ্য হন তিনি।
১৯৪২ সালের ১ আগস্ট কর্নাটকের উদুপিতে শেট্টির জন্ম। বাবা শম্ভু শেট্টি এবং মা কুসাম্মা শেট্টি। তিনি পড়াশোনা করেছিলেন স্থানীয় স্কুল থেকে।
স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পর মণিপাল থেকে ফার্মাসি নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন শেট্টি। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন এক জন মেডিক্যাল রিপ্রেজ়েনটেটিভ হিসাবে। পরে উদুপি পুরসভার ভাইস-চেয়ারম্যান হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন।
এর পর চন্দ্রকুমারী নামে এক চিকিৎসককে বিয়ে করেন শেট্টি। কিন্তু কর্নাটকে মন টিকছিল না শেট্টির। জীবনে উন্নতি করতে দুবাই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
১৯৭৩ সালে, শেট্টির যখন ৩১ বছর বয়স, তখন মাত্র ৮ ডলার পকেটে নিয়ে দুবাই চলে যান তিনি। নতুন করে শুরু করেন সব কিছু।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুবাইয়ে প্রথম জীবন সুখের ছিল না শেট্টির। অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন তিনি। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ওষুধ বিক্রি করতেন। শীঘ্রই কঠোর পরিশ্রম তাঁর জীবনে সাফল্য আনে। কর্মজীবনে উন্নতি হওয়ার পাশাপাশি আর্থিক উন্নতিও হয় তাঁর।
জমানো পুঁজি দিয়ে শীঘ্রই সংযুক্ত আরব আমিরাশাহিতে ‘নিউ মেডিক্যাল সেন্টার’ (এনএমসি) নামে একটি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র তৈরি করেন শেট্টি। প্রথমে ওই স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে একমাত্র চিকিৎসক ছিলেন শেট্টির স্ত্রী চন্দ্রকুমারী।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে ধারে-ভারে বাড়তে থাকে এনএমসি। সংযুক্ত আরব আমিরাশাহির অন্যতম বড় বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে ওই সংস্থা।
১৯৮০ সালে ‘ইউএই এক্সচেঞ্জ’-এর প্রতিষ্ঠাতা ড্যানিয়েল ভার্গিসের কাছ থেকে সেই সংস্থা কিনে নেন শেট্টি। প্রবাসীরা যাতে নিজেদের পরিবারের কাছে সহজে টাকা পাঠাতে পারেন, তাই ‘ইউএই এক্সচেঞ্জ’ সংস্থাটি তৈরি হয়েছিল।
পরে ‘এনএমসি নিয়োফার্মা’ নামে একটি ওষুধের সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যকে আরও প্রসারিত করেন শেট্টি। তাঁর নেতৃত্বে এনএমসি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাশাহির বৃহত্তম বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
আরব আমিরশাহির বাইরেও প্রভাব বিস্তার করে এনএমসি। লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জেও তালিকাভুক্ত হয় শেট্টির সেই সংস্থা। ‘ইউএই এক্সচেঞ্জ’ এবং ‘এনএমসি নিয়োফার্মা’র ব্যবসাও ফুলে ফেঁপে ওঠে।
শেট্টির ব্যবসায়িক সামাজ্য রিয়েল এস্টেট পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। শীঘ্রই আরব আমিরশাহির অন্যতম বিত্তশালী ব্যবসায়ী হিসাবে সুখ্যাতি অর্জন করেন তিনি।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে শেট্টির সম্পত্তির পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। বিলাসবহুল জীবনযাপনের কারণেও চর্চায় থাকতেন শেট্টি।
একাধিক নামীদামি গাড়ি, ব্যক্তিগত বিমান, দুবাইয়ে একাধিক ভিলা-সহ অনেক বিলাসবহুল সম্পত্তির মালিক ছিলেন শেট্টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বুর্জ খলিফার দু’টি তলায় তাঁর একাধিক ফ্ল্যাট।
২০১৭ সালে অন্য একটি কারণে ভারতীয় সিনেমাপ্রেমীদের মধ্যেও হইচই ফেলেছিলেন শেট্টি। জল্পনা তৈরি হয়েছিল, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির ভারতীয় ব্যবসায়ী ভারতে ‘মহাভারত’ তৈরির জন্য প্রায় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চলেছেন। যদিও সেই জল্পনা রয়ে গিয়েছিল জল্পনার স্তরেই।
তবে জীবনে উত্থান যেমন দেখেছেন শেট্টি, তেমন পতনও দেখেছেন। ২০১৯ সালে আমেরিকার শর্ট সেলার সংস্থা ‘মাডি ওয়াটার্স রিসার্চ’ শেট্টি এবং তাঁর সংস্থার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনে।
শেট্টির সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে ১০০ কোটি ডলারের বিশাল ঋণ গোপন করা এবং আর্থিক জালিয়াতির অভিযোগ তোলে ‘মাডি ওয়াটার্স রিসার্চ’। এই অভিযোগের ফলে তাঁর সংস্থাগুলির শেয়ারের দর হু়ড়মুড়িয়ে পড়তে থাকে। সেই শেয়ারের দর আর বাড়েনি।
একাধিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অভিযোগের মুখে পড়ে বাধ্য হয়ে ১২,৪৭৮ কোটি টাকার ব্যবসা মাত্র ৭৪ টাকায় ইজ়রায়েল-সংযুক্ত আরব আমিশাহির একটি কনসোর্টিয়ামের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হন শেট্টি। আর্থিক অনিয়ম সংক্রান্ত তদন্তের মুখে পড়়ে ২০২০ সালে এনএমসি থেকে পদত্যাগ করেন তিনি।
শেট্টির ব্যবসাগুলি ফৌজদারি অভিযোগের মুখোমুখি হয় এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সরকার তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলি ‘ফ্রিজ়’ করে। সংস্থাগুলিকে কালো তালিকাভুক্তও করা হয়। ফলে তার এক সময়ের সমৃদ্ধ ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে।