ভয়াবহ ভূমিকম্পে মায়ানমারে মৃত্যুমিছিল। পূর্বের প্রতিবেশী দেশটিতে জীবনহানি পাঁচ হাজারের বেশি বাসিন্দার। রাতারাতি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে সাবেক বর্মা মুলুক। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে সেখানে ‘অপারেশন ব্রহ্মা’ চালাচ্ছে ভারতীয় ফৌজ ও উদ্ধারকারী দল। কিন্তু, এই ঘটনার পর স্বাভাবিক ভাবেই উঠেছে একটি প্রশ্ন। আগামী দিনে মারাত্মক ভাবে কেঁপে উঠবে কোন কোন দেশের মাটি? তালিকায় নাম আছে ভারতের?
মায়ানমার বিপর্যয়ের পর বড় ধরনের ভূকম্পনের সতর্কতা জারি করে জাপান। টোকিয়োর বিজ্ঞানীদের দাবি, রিখটার স্কেলে সেই মেগা ভূমিকম্পের তীব্রতা হতে পারে নয়। ফলে প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কায় ঘুম উড়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের ওই দ্বীপরাষ্ট্রের। যদিও চুপিসারে সেই বিপদ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোন দেশকে ধাক্কা মারবে, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়।
তবে ভূবিজ্ঞানীদের একাংশ মনে করেন, আগামী দিনে ভূমিকম্পে সাবেক বর্মা মুলুকের মতো বা তার চেয়েও বেশি লোকসান হতে পারে এশিয়ার তিনটি শক্তিধরের। দেশগুলি হল চিন, জাপান ও ভারত। সম্প্রতি এ ব্যাপারে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূবিদ্যার অধ্যাপক ক্রিস গোল্ডফিঙ্গার। তিনি বলেছেন, ‘‘পায়ের তলার মাটি যে কেঁপে উঠে হঠাৎ করে সরে যাবে, তা আমরা নিশ্চিত। শুধু কোথায় এবং কখন, সেটা জানি না।’’
আমেরিকার ভূতাত্ত্বিকদের দাবি, ২০৬০ সালের মধ্যে বিশ্বের ভূকম্পনপ্রবণ এলাকায় মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা ৩৭ শতাংশ। সেই তালিকায় একেবারে মাথার দিকে রয়েছে এশিয়ার তিন দেশের নাম। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ১৭০০ সালের গোড়ায় সর্বশেষ মেগা ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটে। আর তাতে উত্তর আমেরিকার অনেক কিছুই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, কম্পনের জেরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় সুনামিতে বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল জাপানও।
এই পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লিকে সর্বাধিক সতর্কবার্তা দিয়েছেন দুনিয়ার তাবড় ভূবিজ্ঞানীরা। তাঁদের দাবি, ‘মহা হিমালয়ান ভূমিকম্প’-এ (গ্রেট হিমালয়ান আর্থকোয়েক) ধ্বংস হতে পারে গোটা উত্তর ভারত। রিখটার স্কেলে যার কম্পনের মাত্রা দাঁড়াবে আট বা তার বেশি। এতে ৩০ কোটির বেশি মানুষের জীবনহানির আশঙ্কা করেছেন তাঁরা। পাশাপাশি, একাধিক শহর রাতারাতি ধুলোয় মিশতে পারে বলেও মিলেছে পূর্বাভাস।
কেন উত্তর ভারতে বড় ভূমিকম্প আসতে পারে, সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন মার্কিন ভূপদার্থবিজ্ঞানী রজার বিলহাম। তিনি বলেন, ‘‘ভারতের টেকটনিক প্লেট ধীরে ধীরে তিব্বতীয় টেকটনিক প্লেটের নীচে চলে যাচ্ছে। প্রতি শতাব্দীতে এর চলন আনুমানিক দু’মিটার। এই ঘর্ষণের ফলে উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। তা ছাড়া এর ফলে যে অফুরন্ত শক্তি তৈরি হচ্ছে, একটা সময়ে তার নির্গমন শুরু হবে। তখনই প্রবল ভাবে দুলে উঠবে মাটি।’’
রজার জানিয়েছেন, গত ৭০ বছরে সে ভাবে শক্তি নিগর্ত করেনি হিমালয়ান প্লেট। কিন্তু, অনিবার্য ভাবেই সেই বিপর্যয় আসতে চলেছে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ভূবিজ্ঞানীদের সমীক্ষা বলছে, ভারতের ৫৯ শতাংশ জমি ভূমিকম্পপ্রবণ। এর মধ্যে উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে হিমাচলপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, বিহার এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সমস্ত রাজ্য। অন্য দিকে দিল্লি, মুম্বই এবং কলকাতার মতো শহরগুলি ভূগর্ভস্থ প্লেটের চিড় বা ফল্ট রেখার উপর অবস্থিত।
কিছু দিন আগেই রাজধানী ও তার আশপাশের রাজ্যগুলিতে ভূকম্পন অনুভূত হয়েছিল। রিখটার স্কেলে এর তীব্রতা ছিল মাত্র চার। ভূবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, উত্তর ভারতের দিল্লি ও হরিদ্বার মরুরাজ্য রাজস্থানের আরাবল্লী পর্বতমালার একটি সম্প্রসারিত অংশ। ফলে সেখানকার ফল্ট লাইনের ঝুঁকি তুলনামূলক ভাবে কম।
মেগা ভূমিকম্পের হটস্পট হিসাবে ভূবিজ্ঞানীরা ভারতের পাশাপাশি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র ফিলিপিন্সকেও চিহ্নিত করেছেন। সেখানকার লুজ়নের কাছে মারিকিনা ভ্যালি ফল্ট সিস্টেমে তীব্র কম্পন অনুভূত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জায়গাটা রাজধানী ম্যানিলা-সহ তিন হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এবং অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ। সেখানে রিখটার স্কেলের সাত তীব্রতার ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। আর তাতে লাখ ছাড়াতে পারে প্রাণহানির সংখ্যা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাসাগরীয় ও বায়ুমণ্ডলীয় প্রশাসনের (ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্পিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা এনওএএ) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সর্বাধিক ভূমিকম্প হয়েছে চিনে। এই সময়সীমার মধ্যে মান্দারিনভাষীদের জমি কেঁপেছে ১৮৬ বার। ভূকম্পনের জেরে সুনামির ধাক্কাও সইতে হয়েছে ড্রাগনভূমিকে।
তবে ভূমিকম্পে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে সরকারি ভাবে কোনও সুস্পষ্ট তথ্য দেয়নি চিন। ড্রাগনভূমিতে ৭.৫ তীব্রতার কম্পনও নথিবন্ধ করে আমেরিকার সরকারি সংস্থা এনওএএ। বেজিঙের দাবি, তাতে নাকি মৃত্যু হয়েছে মাত্র ১০ জনের। এই তথ্যও সঠিক বলে মানতে নারাজ পশ্চিমি দুনিয়া।
ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে চিন ও ভারতের একই রকমের কিছু সমস্যা রয়েছে। দু’টি দেশের শহর এবং শহরতলি এলাকায় বিপুল সংখ্যায় গগনচুম্বী অট্টালিকা রয়েছে। ফলে তীব্র ভূকম্পন শুরু হলে সেগুলির তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ার আশঙ্কা প্রবল। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল বিপুল জীবনহানি ও আর্থিক লোকসান।
১৯৯০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ভূমিকম্পের সংখ্যার নিরিখে সপ্তম স্থানে রয়েছে ভারত। গত সাড়ে তিন দশকে ৫৮টি ভূকম্পনের ধাক্কা সহ্য করতে হয়েছে নয়াদিল্লিকে। তালিকায় দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, ইরান এবং জাপান। সেখানে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে ১৬৬, ১০৯ এবং ৯৮ বার। একই সময়ের মধ্যে ৭৮ বার দুলে উঠেছে আমেরিকার মাটি। তালিকায় তাই পঞ্চম স্থান পেয়েছে প্রশান্ত ও আটলান্টিকের পারের ‘সুপার পাওয়ার’।
২০০১ সালের ভূমিকম্পে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গুজরাটের ভুজ। এই বিপর্যয়ে সরকারের আর্থিক লোকসানের অঙ্ক ছিল হাজার কোটি ডলার। ২০১৫ সালের নেপালের ভূমিকম্পের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা। এতে ৭০০ কোটি ডলারের লোকসানের মুখে পড়ে সরকার।
একটা সময়ে বিশ্বের সর্বাধিক ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ ছিল জাপান। তাই, ভূমিকম্পের ফলে ঘটা ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে গৃহনির্মাণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু কড়া নিয়ম রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রে। ফলে বছরের পর বছর কম্পন ও সুনামি সহ্য করে টিকে আছে তারা। ভারতেরও একই ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
বিশেষজ্ঞদের কথায়, ভুজের ঘটনার থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারি বা বেসরকারি স্তরে কোনও সতর্কতা নেওয়া হয়নি। ফলে অবৈজ্ঞানিক ভাবে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় সুউচ্চ অট্টালিকা নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কলকাতার মতো পুরনো শহরে আবার ইতিউতি ছড়িয়ে আছে শতাব্দীপ্রাচীন বহু বাড়ি। সংস্কারের অভাবে সেগুলির অধিকাংশের অবস্থা খুবই খারাপ। এতে শহর জুড়ে তৈরি হয়েছে মৃত্যুফাঁদ।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে অবস্থার কিছুটা বদল হয়েছে। একাধিক আইআইটির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে দেশের বিভিন্ন শহরের পুর প্রশাসন। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে কিছু ক্ষেত্রে পদক্ষেপ করছেন সরকারি আধিকারিকেরা। তবে তার পরও গৃহনির্মাণের ক্ষেত্রে কড়া আইন তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন বিশ্লেষকেরা।
গত ২৮ মার্চ যে ভূমিকম্পের ধাক্কায় দুলে ওঠে মায়ানমার, তার তীব্রতা ছিল ৭.৭। গবেষকেরা জানিয়েছেন, কম্পনের ফলে যে শক্তি নির্গত হয়েছে, তা ৩০০টি পরমাণু বোমার সমান। দু’সপ্তাহের মাথায় ১৩ এপ্রিল ফের সাবেক বর্মা মুলুকে আঘাত হানে ভূমিকম্প। দ্বিতীয় বার কম্পনের মাত্রা ছিল ৫.৬। ফলে কলকাতা-সহ ভারত জুড়ে বেড়েছে আতঙ্ক।