১ এপ্রিল, শনিবার। ঘড়ির কাঁটায় রাত ৮টা। শক্তিগড়ের ল্যাংচা হাবের সামনে এসে দাঁড়ায় সাদা রঙের একটি চার চাকা গাড়ি। ভিতরে ছিলেন রাজু, ওরফে রাজেশ ঝা।
আসানসোল-রানিগঞ্জ কয়লাখনি এলাকায় অতিপরিচিত নাম এই রাজু। কেউ কেউ বলেন, নাম না বলে তাকে ‘বদনাম’ বললেও অত্যুক্তি হয় না। কয়লার বেআইনি কারবারের সঙ্গে নাকি ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিলেন এই রাজু।
৬২ বছরের সেই কয়লা মাফিয়া রাজুকে মরতে হল শনিবার। ল্যাংচা হাবের সামনে যখন তাঁর গাড়ি দাঁড়িয়েছিল, সেই সময় কলকাতার দিকে যাওয়া একটি নীল গাড়ি থেকে গুলি ছোড়া হয়। ঝাঁঝরা হয়ে যান রাজু।
রাজু খুনের তদন্তে রবিবারই জেলা পুলিশ সুপার কামনাশিস সেনের নির্দেশে ১২ সদস্যের সিট গঠন করা হয়েছে। কোমর বেঁধে তদন্তে নেমেছে পুলিশ। আততায়ীদের খোঁজে ঝাড়খণ্ডেও গিয়েছে তদন্তকারীদের একটি দল।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, আশির দশকের শেষ দিকে থেকে রাজু কয়লা পাচারচক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তার পর কালক্রমে তিনিই হয়ে উঠেছিলেন এই চক্রের অন্যতম মাথা, অন্যতম নিয়ন্ত্রক। ‘প্রভাবশালী’ রাজুর এই আকস্মিক মৃত্যু কয়লাখনি এলাকায় আলোড়ন ফেলে দিয়েছে।
কিন্তু রাজু তো প্রথম নন!। মধ্য বাংলার কয়লা বলয়ের ইতিহাস বরাবরই রক্তাক্ত। নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু করে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তিন দশকে অপরাধ এবং খুনোখুনির ছবিতে খুব একটা বড় কোনও বদল আসেনি।
রাজুর মতো আরও অনেকেই আসানসোল, রানিগঞ্জে সক্রিয় কয়লা পাচারচক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। বেআইনি পথে কালক্রমে তাঁদেরও প্রতিপত্তি বেড়েছে, সম্পত্তি উঠেছে ফুলেফেঁপে। তার পর এক সময় তাঁদেরও মরতে হয়েছে রাজুর মতোই।
নব্বইয়ের দশকে শুধু আসানসোল বা রানিগঞ্জ নয়, পশ্চিম বর্ধমানের নানা প্রান্তে রাতারাতি গজিয়ে ওঠে একগুচ্ছ অবৈধ কয়লা খাদান। প্রকাশ্যেই যেখানে বেআইনি কয়লার কারবার চলত। স্থানীয়দের দাবি, কয়লা চুরি হত প্রকাশ্যেই।
কয়লা মাফিয়াদের বাড়বাড়ন্ত এবং নৃশংস হত্যার ইতিহাসের দিকে চোখ রাখলে প্রথমেই যাঁর নাম উঠে আসে, তিনি অশোক কুর্মি। অভিযোগ, কয়লা পাচারচক্রের সঙ্গে সক্রিয় যোগাযোগ ছিল তাঁর। বলা চলে, নৃশংসতার পথ দেখাল অশোকের মৃত্যুই।
১৯৯৪ সালের লক্ষ্মীপুজোর কয়েক দিন পরে অন্ডাল বিমানবন্দর লাগোয়া এলাকার জঙ্গলে উদ্ধার হয় অশোকের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। কেউ বা কারা তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে খুন করেছিলেন। প্রথমে যা কাকপক্ষীতেও টের পায়নি। খুনের চার দিন পর অশোকের দেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
বর্ধমানের অবৈধ কয়লা ব্যবসায়ীদের মধ্য অন্যতম পরিচিত নাম কালোসোনা রুইদাস। কয়লার ব্যবসায় তিনিও নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়িয়ে তুলেছিলেন অনেকখানি। ২০০৮ সালে তাঁকে খুন করা হয়।
চুরুলিয়ার বাসিন্দা কালোসোনা বেলডাঙা সিন্ধিচকে নিজের কারখানায় যাচ্ছিলেন। পথে মোটরবাইকে এসে দু’জন তাঁর গাড়ি তাক করে প্রকাশ্যে গুলি ছোড়েন। ঘটনাস্থলেই মারা যান কালোসোনা।
কালোসোনার ঠিক পরের বছর কয়লা ব্যবসায়ী রমানন্দ যাদবকে প্রায় একই কায়দায় খুন করেন দুষ্কৃতীরা। তবে এ ক্ষেত্রে আর প্রকাশ্য রাস্তা নয়, খুন করতে একেবারে রমানন্দের বাড়ি পৌঁছে গিয়েছিলেন তাঁরা।
অন্ডালের বেনিয়াডিহিতে বাড়ি ছিল রমানন্দের। ২০০৯ সালে আততায়ীরা তাঁকে বাড়িতে ঢুকে গুলি করে খুন করেন। এই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। রমানন্দের মৃত্যুরহস্য অধরা থেকে গিয়েছে।
কালোসোনার মৃত্যুর পর আসানসোল রানিগঞ্জ এলাকায় খুনোখুনি যেন কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল। ২০০৯ সালে রমানন্দের মৃত্যুর পর ২০১০ সালেই আবার প্রকাশ্যে আসে আর এক হত্যাকাণ্ড। প্রকাশ্যে রাস্তায় খুন হন কয়লার কারবারি শেখ বাবলু।
বাবলু ছিলেন উখড়া এলাকার বাসিন্দা। একটি পেট্রল পাম্পের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে তিনি নামতে যাচ্ছিলেন। সেই সময় মোটরবাইকে চেপে পেট্রল পাম্পের সামনে আসেন দু’জন। তাঁদের মধ্যে এক জন গুলি চালান। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় বাবলুর।
২০১১ সাল। বার্নপুর রোডে নির্মীয়মাণ হোটেলে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যান হোটেল ও নির্মাণ ব্যবসায়ী রামলক্ষ্মণ যাদব। হিরাপুরের ৮ নম্বর বস্তি এলাকার বাসিন্দা রামলক্ষ্মণের খুনের নেপথ্যে কয়লার ব্যবসা সংক্রান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল বলে পুলিশ দাবি করেছিল।
রামলক্ষ্মণের পর পরের বছরেই আরও এক খুন। ২০১২ সালে দুষ্কৃতীদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যান বেআইনি কয়লার কারবারে অভিযুক্ত শেখ সেলিম। তাঁকে লাউদোহার মাধাইগঞ্জে নিজের বাড়ির সামনেই গুলি করেন আততায়ীরা।
সেলিমের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ ছিল, অল্প দামে ‘ডোমেস্টিক কোল’ কিনে সেই কয়লা বেশি দামে অন্যত্র বিক্রি করে দিতেন। এ ভাবে প্রচুর টাকা কামিয়েছিলেন।
উৎসবের দিন মরতে হয়েছিল বেআইনি কয়লা ব্যবসায়ী শেখ আমিনকে। দুর্গাপুর-ফরিদপুর ব্লকের কৈলাসপুরে ২০১৬ সালে ইদের দিন আমিনকে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেন দুষ্কৃতীরা। পশ্চিম বর্ধমান ও বীরভূমে অজয় নদের দু’পাড়ে বিভিন্ন থানায় বেআইনি কয়লার কারবার ও ২১টি খুনের মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন তিনি।
হাল আমলে ২০২৩ সালেই আসানসোলে খুন হন হোটেল ব্যবসায়ী অরবিন্দ ভগৎ। আসানসোলের ভগৎ সিংহ মোড়ের অদূরে সেন-র্যালে রোডে নিজের হোটেলের ভিতরেই তাঁকে গুলি করা হয়। পুলিশ জানিয়েছিল, হোটেল ব্যবসা, সুদ এবং জমির আন্তঃরাজ্য ব্যবসা ছিল তাঁর।
অরবিন্দের পর হত্যাকাণ্ডের এই দীর্ঘ তালিকায় নতুন সংযোজন রাজু। তিনি গেরুয়া রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে দাবি। শক্তিগড়ে ল্যাংচা হাবের সামনে তিনিও ঝাঁঝরা হলেন আততায়ীদের গুলিতে।