নগ্নতা। প্রতিবাদের অন্য এক ভাষা। তথাকথিত সভ্য সমাজ আদিকাল থেকে যা ঢাকতে শিখিয়েছে তাকেই বুক চিতিয়ে প্রকাশ্যে মেলে ধরা। বেপরোয়াগিরির শেষ কথা।
নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ নতুন করে খবরে এসেছে কান চলচ্চিত্রোৎসবের সৌজন্যে। ফ্রান্সের দক্ষিণের এই শহরে ৭৫তম আন্তর্জাতিক ছবি প্রদর্শনের আসর বসেছিল। ছবির কুশীলবদের স্বাগত জানাতে পাতা হয়েছিল লাল গালচে। কানের সেই চোখ ধাঁধানো লাল গালচেতেই আচমকা পোশাক খুলে ফেললেন এক অতিথি।
নগ্ন হয়েই গালচের দু’পাশে দাঁড়ানো ফোটোগ্রাফারদের সামনে চলে আসেন তিনি। পরনে ছিল শুধু নিম্নাঙ্গের অন্তর্বাস। তাতে আঁকা ছিল রক্তের দাগ। অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গে নীল হলুদ রঙের উপর লেখা ছিল— ‘আমাদের ধর্ষণ কোরো না’।
ইউক্রেনের নীল হলুদ পতাকার রঙে শরীর রাঙিয়েছিলেন তরুণী। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির মহিলাদের উপর রুশ সেনার যৌন অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই কানের মতো আন্তর্জাতিক মঞ্চকে ব্যবহার করেন তিনি। গোটা দুনিয়ার সামনে আবরণ মুক্ত করেন নিজেকে।
তবে প্রতিবাদের জন্য পোশাক খুলে ফেলা এই প্রথম নয়। সামাজিক অধিকার পেতে সমাজবিপ্লবীরা নগ্ন হয়েছেন বহু বার। কারণ যে সব সময় যৌন নির্যাতন, তা নয়। প্রতিবাদের কারণ হিসেবে কখনও জায়গা করে নিয়েছে জমির অধিকার, কখনও জলবায়ু পরিবর্তন, কখনও বা যুদ্ধ বিরোধিতা।
নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ জানানোর ঘটনা সবচেয়ে বেশি বোধ হয় দেখেছে ফ্রান্সই। বছর খানেক আগে বেতন পরিকাঠামোর বদলের প্রতিবাদেও সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে পথে নেমেছিলেন সরকারি কর্মচারীরা। নগ্ন হয়ে একে অন্যের কাঁধে চেপে তৈরি করেছিলেন নগ্ন মানুষের পিরামিড। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনা করতে এসেছিলেন ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক মন্ত্রী। তাঁকে ওই ‘ন্যুড পিরামিড’-এর মুখোমুখি হতে হয়।
পোশাকে পশমের ব্যবহারের প্রতিবাদ— তার জন্যও নগ্ন হয়েছেন পশু অধিকার আন্দোলনকর্মীরা। ফ্রান্সে তো বটেই গোটা বিশ্বে চলেছে সেই আন্দোলন। আন্দোলনকারীরা শরীরে একটি সুতোও না রেখে পড়েছিলেন শুধু পশুর মুখোশ।
ভারতেও হয়েছে নগ্ন প্রতিবাদ। ২০০৪ সালে মণিপুরে ১২ জন মহিলা নগ্ন হয়ে রাস্তায় নামেন। ইম্ফলে কাঙ্গলা ফোর্টের সামনে প্রকাশ্যে নগ্ন হন তাঁরা। শরীর ঢাকেন একটি কাপড়ের ব্যানারে। তাতে লেখা ছিল, ‘ভারতীয় সেনা আমাদের ধর্ষণ করো।’
মণিপুরের ওই নগ্ন প্রতিবাদ ছিল অসম রাইফেলসের বিরুদ্ধে। মনোরমা নামে এক যুবতীকে জেরা করার নামে বাড়ি থেকে তুলে ধর্ষণ করে খুন করার অভিযোগ উঠেছিল অসম রাইফেলসের কয়েক জন জওয়ানের বিরুদ্ধে।
নগ্ন হয়ে প্রতিবাদকারী মণিপুরের ওই ১২ জন মহিলাকে ‘মণিপুরের মা’ বলা হয়েছিল সেই সময়ে। প্রতিবাদের সময় তাঁরা বলেছিলেন, ‘‘আমরা সবাই মনোরমার মা। আমাদেরও নিয়ে যাও, ধর্ষণ করো, মেরে ফেলো।’’
জমির অধিকার চেয়ে নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ আন্দোলনে নেমেছিলেন উগান্ডার মেয়েরা। কৃষিজমি হাতছাড়া হওয়ার প্রতিবাদে উগান্ডার আমুরু জেলার মেয়েরা পোশাক খুলে পথে নামেন।
ইরাকের যুদ্ধ থামাতে চেয়ে নগ্ন হয়েছেন মানুষ। ফ্লোরিডার পাম সৈকতে নগ্ন হয়ে শান্তির প্রতীক তৈরি করেছিলেন তাঁরা। পোশাক খুলে প্রতিবাদ সামিল হয়েছিলেন হাজার খানেক মানুষ।
২০১৬ সালের ২৯ জুন কেমব্রিজের এক শিক্ষাবিদ অর্থনীতিবিশারদদের বৈঠকে ঢুকে পড়েন সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে। তাঁর শরীরে লেখা ছিল ‘ব্রেক্সিট ব্রিটেনকে নগ্ন করে দেবে’।
এক রূপান্তরকামী তাঁর অধিকার রক্ষার জন্য নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন আমেরিকার টেনেসিতে। ড্রাইভিং লাইসেন্সে তাঁর লিঙ্গে পুরুষের বদলে মহিলা লেখার অনুরোধ করেছিলেন তিনি। যা মানতে চাননি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। প্রতিবাদে পোশাক খুলে ফেলেন তিনি। সে কাজের জন্য অবশ্য তাঁকে জেলেও যেতে হয়।
আর্জেন্টিনার বুয়েনাস আইরেসে মহিলাদের বিরুদ্ধ হিংসার প্রতিবাদে পোশাক খুলে পথে নেমেছিলেন শতাধিক মহিলা।
অতি সংরক্ষণশীল বলে পরিচিত আরবেও হয়েছে নগ্ন প্রতিবাদ। নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার দাবিতে আরবের মহিলারাও নিজেদের নগ্ন ছবি পোস্ট করেছিলেন ইন্টারনেটে।
আবার নেহাত ঊর্ধ্বাঙ্গের আবরণ থেকে মুক্ত হত চেয়েও পোশাক খুলেছেন আন্দোলনকারীরা। তাঁদের দাবি ছিল, পুরুষদের মতো তাঁরাও বিনা বাধায় ঊর্ধ্বাঙ্গ উন্মুক্ত করতে চান। সমাজে পুরুষ নারী দু’পক্ষেরই সমানাধিকার হওয়া উচিত।