মাফিয়াদের গুলি ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল। এক বার নয়, সাত বার। তাতে শরীরের একাধিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নষ্ট হয়েছে। তার পরেও দমেননি রিঙ্কু সিংহ রাহি। ইউপিএসসি পরীক্ষায় ৬৮৩ স্থান অধিকার করেছেন তিনি।
২০০৯ সালে একটি বড় মাপের দুর্নীতি হাতেনাতে ধরেছিলেন রিঙ্কু। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৬। সেই দুর্নীতি ধরে ফেলার ফলই ভুগতে হয়েছিল রিঙ্কুকে।
রিঙ্কুর মুখ লক্ষ্য করে ছুটে এসেছিল বুলেট। সেই বুলেটের ক্ষত আজও স্পষ্ট তাঁর মুখে। স্বাভাবিক আকৃতি আর নেই। নষ্ট হয়েছে একটি চোখ। গুলি লাগার কারণে কানেও ভাল শুনতে পান না তিনি। এত প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে ইউপিএসসি পরীক্ষায় সফল রিঙ্কু।
রিঙ্কু আদতে উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ের ডোরি নগরের বাসিন্দা। ২০০৮ সালে উত্তরপ্রদেশ সরকারের প্রভিনশিয়াল সিভিল সার্ভিস (পিসিএস) পরীক্ষা পাশ করেন তিনি। তার পর তিনি হাপুরের সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অফিসার নিযুক্ত হন।
রিঙ্কুর বাবা শিবদান সিংহ জানিয়েছেন, তাঁদের আর্থিক অবস্থা একেবারেই ভাল ছিল না। তাই ছেলেকে সরকারি স্কুলে পড়িয়েছিলেন তিনি। উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল ফল করায় বৃত্তি পেয়েছিলেন রিঙ্কু। তার পর বিটেক পড়েন।
বিটেক পাশ করে ২০০৮ সালে পিসিএস পাশ করেন। সরকারি আধিকারিক নিযুক্ত হন তিনি। ২০০৮ সালে মুজফ্ফরনগরের সোশাল ওয়েলফেয়ার অফিসার নিযুক্ত হন।
২০০৯ সালে নিজের দফতরেরই ৮৩ কোটি টাকার দুর্নীতি রিঙ্কু ধরে ফেলেন রিঙ্কু। তা প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন। এর পর নিজের দফতরেরই একটা বড় অংশ শত্রু হয়ে ওঠে রিঙ্কুর।
এক দিন সকালে নিজের বাড়িতে ব্যাডমিন্টন খেলছিলেন রিঙ্কু। তখনই তাঁকে লক্ষ্য করে ছুটে আসে গুলি। সে দিন রিঙ্কুর শরীরে বিঁধেছিল সাতটি বুলেট।
ভাগ্যদেবী প্রসন্ন ছিলেন। তাই সে দিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন রিঙ্কু। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘‘আমি সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়ছিলাম না। আসলে সিস্টেমই আমার বিরোধিতা করছিল।’’
রিঙ্কু জানিয়েছেন, গুলিতে আক্রান্ত হওয়ার পর চার মাস হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন রিঙ্কু। কিন্তু মেডিক্যাল লিভ দেওয়া হয়নি তাঁকে।
মায়াবতীর সরকার হোক বা অখিলেশ যাদবের, রিঙ্কুর কাছে সকলেই সমান। তাঁর কথায়, ‘‘আমার কাছে সকলেই এক।’’ মায়াবতী সরকারের আমলে গুলি খেয়েছিলেন তিনি। পরে অখিলেশ ক্ষমতায় এলেও ছবিটা পাল্টায়নি বলে অভিযোগ রিঙ্কুর।
রিঙ্কু জানিয়েছেন, অখিলেশ ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে মনরোগ দফতরে পাঠানো হয়েছিল। তাঁর মতে, দু্র্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুলতেন বলেই তাঁকে সরতে হয়েছিল।
চাকরিতে বার বার বদলি হতে হয়েছে রিঙ্কুকে। প্রথমে মুজফ্ফরনগরে নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে ভাদোহিতে বদলি হন। তার পর একে একে শ্রাবস্তী, ললিতপুর, হাপুরে বদলি হন তিনি।
হাপুরে জেলা সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অফিসার পদে থাকাকালীন রিঙ্কুকে সিভিল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ডিরেক্টর নিযুক্ত করা হয়। সরকার ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালাত। এর পর তিনি আলিগড়ে আইএএস-পিসিএস প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রধান হয়ে যান।
প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত থাকার সময় নিয়মিত ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতেন রিঙ্কু। ইউপিএসসি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করতেন। সেই ছাত্র-ছাত্রীরাই বার বার রিঙ্কুকে ইউপিএসসি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য জোরাজুরি করতেন।
রিঙ্কুর বাবা জানিয়েছেন, ছাত্র-ছাত্রীদের জোরাজুরিতেই ২০২১ সালে ইউপিএসসি পরীক্ষা দেন ছেলে। ৬৮৩ নম্বর স্থান অধিকার করেন।
রিঙ্কু ৪০ বছর বয়সে ইউপিএসসি পাশ করেন। এমনিতে জেনারেল ক্যাটেগরিতে ৩২ বছর পর্যন্ত এই পরীক্ষায় বসা যায়। ওবিসি, তফশিলি জাতি এবং উপজাতি এবং কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে বয়সের ছাড় রয়েছে। রিঙ্কুও বিশেষ ক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েই ইউপিএসসিতে সফল। সর্বোচ্চ বয়সে ছাড় দেওয়া হয় তাঁকে।
রিঙ্কুর লক্ষ্য, এক জন সৎ আইএএস অফিসার হওয়া। ছোট থেকে তাঁকে টেনেছে সততা। এর নেপথ্যে রয়েছে তাঁদের পারিবারিক অবস্থা। রিঙ্কুর বাবা যখন খুব ছোট, তখন মারা গিয়েছিলেন তাঁর ঠাকুরদা। সংসার চালানোর জন্য কাজ নিতে হয়েছিল রিঙ্কুর ঠাকুমাকে।
রিঙ্কুর বাবা শিবদান পড়াশোনায় খুব ভাল ছিলেন। কিন্তু অর্থাভাবে মাঝপথেই পড়াশোনা ছাড়তে বাধ্য হন। রিঙ্কু এবং তাঁর পরিবার এ সবের জন্য সরকারি আধিকারিকদের অসততাকেই দায়ী করেন। রিঙ্কু মনে করেন, সে দিন সরকারি দফতরে কোনও সৎ আধিকারিক থাকলে তাঁর বাবাকে সাহায্য করতেন। এ ভাবে পড়াশোনা ছাড়তে হত না।
রিঙ্কু জানিয়েছেন, তাঁকে যখন দুর্নীতি চাপা দেওয়ার জন্য ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন কয়েক জন, তখন তা খারিজ করেছিলেন নিজের বাবার কথা ভেবে। তাঁর মনে হয়েছিল, তিনি ঘুষ নিলে অন্য কোনও ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা মাঝপথে থেমে যাবে।