১৪ বছর বয়সে কেরিয়ার শুরু, কম বয়সেই গায়িকা হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন নাজ়িয়া হাসান। অভিনেত্রী জ়িনত অমানের হাত ধরে সঙ্গীতজগতে পা রেখেছিলেন নাজ়িয়া। কিন্তু যাঁর জন্য তিনি নিজের কেরিয়ার থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাঁর কাছেই নাকি হেনস্থার শিকার হতে হয়েছিল নাজ়িয়াকে। ৩৫ বছর বয়সে মারা যান নাজ়িয়া। তাঁর মৃত্যুকে ঘিরেও রয়েছে রহস্য।
১৯৬৫ সালের ৩ এপ্রিল পাকিস্তানের করাচিতে জন্ম নাজ়িয়ার। তাঁর বাবা পেশায় ছিলেন শিল্পপতি। নাজ়িয়ার মা ছিলেন সমাজকর্মী। ভাই জোহেব হাসানের সঙ্গে বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিল নাজ়িয়ার।
পাকিস্তানে জন্ম হলেও ছোটবেলায় পরিবার-সহ লন্ডনে চলে যান নাজ়িয়া। সেখানে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করার পর বিজ়নেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তার পর লন্ডনেই আইন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেন নাজ়িয়া।
শৈশব থেকেই নাজ়িয়ার আগ্রহ ছিল গানবাজনার প্রতি। যদিও দশ বছর বয়সে পাকিস্তানি একটি ধারাবাহিকে শিশু অভিনেত্রী হিসাবে কাজ করেছিলেন তিনি। অবসর সময়ে গিটার বাজিয়ে গান করতে ভালবাসতেন নাজ়িয়া।
নাজ়িয়ার মায়ের সঙ্গে বলি অভিনেত্রী জ়িনত অমানের বন্ধুত্ব ছিল। মাঝেমধ্যেই নাজ়িয়ার বাড়িতে যাতায়াত করতেন জ়িনত। এক দিন নাজ়িয়ার মায়ের সঙ্গে গল্প করার সময় ঘরের ভিতর থেকে নাজ়িয়ার গান শুনতে পান জ়িনত। গানের সঙ্গে ভেসে আসছিল গিটারের সুরও।
নাজ়িয়ার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে যান জ়িনত। তিনি নাজ়িয়ার মাকে জানান, তিনি যেন তাঁর কন্যাকে নিয়ে বলি অভিনেতা-পরিচালক ফিরোজ় খানের সঙ্গে দেখা করেন। বান্ধবীর কথামতো লন্ডনের এক পার্টিতে ফিরোজের সঙ্গে দেখা করেন নাজ়িয়া।
নাজ়িয়ার অডিশন নেওয়ার পর মুগ্ধ হয়ে যান ফিরোজ়। সেই সময় ‘কুরবানি’ ছবির শুটিং নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন ফিরোজ়। ১৯৮০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কুরবানি’ ছবিতে নাজ়িয়াকে গানের প্রস্তাব দেন বলি পরিচালক। ১৪ বছর বয়সে হিন্দি ছবিতে গান গেয়ে রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন নাজ়িয়া।
পপ গায়িকা হিসাবে পরিচিত গড়ে ওঠেন নাজ়িয়া। কিন্তু তাঁর বাবা চাইতেন না যে এত কম বয়সে পড়াশোনার ক্ষতি করে নাজ়িয়া গানবাজনা নিয়ে ব্যস্ত থাকুন। তাই নাজ়িয়া শুধুমাত্র ছুটির দিনেই গান রেকর্ডিং করতে যেতেন।
একের পর এক হিন্দি ছবিতে গান করতে শুরু করেন নাজ়িয়া। দিদিকে দেখে ভাই জোহেবও সঙ্গীতকে কেরিয়ার হিসাবে বেছে নেন। দুই ভাইবোন একসঙ্গে একাধিক গানের অ্যালবাম প্রকাশ করেন।
দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে গানের অনুষ্ঠানও করেছেন নাজ়িয়া। এমনকি গানের রিয়্যালিটি শোয়ের সঞ্চালনার দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। নাজ়িয়া যখন তাঁর কেরিয়ারের শীর্ষে, তখন সকলকে অবাক করে দিয়ে সঙ্গীত জগতের সঙ্গে ধীরে ধীরে দূরত্ব তৈরি করতে শুরু করেন তিনি।
১৯৯৫ সালের ৩০ মার্চ মির্জ়া ইশতিয়াক বাগ নামে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিয়ে হয় নাজ়িয়ার। বিয়ের দু’বছরের মধ্যে এক পুত্রসন্তানেরও জন্ম দেন গায়িকা। কিন্তু বিয়ের পর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করেন গায়িকার।
স্বাস্থ্যপরীক্ষা করে জানা যায়, ক্যানসার বাসা বেঁধেছে নাজ়িয়ার শরীরে। কানাঘুষো শোনা যায় নাজ়িয়ার স্বামী চিকিৎসা করাতে রাজি ছিলেন না। তাই লন্ডনে নিজের বাবা-মায়ের কাছে চলে যান নাজ়িয়া। সেখানে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তাঁকে।
২০০০ সালের ১৩ অগস্ট ৩৫ বছর বয়সে মারা যান নাজ়িয়া। কিন্তু তাঁর মৃত্যুকে ঘিরে রহস্য ঘনিয়ে ওঠে। এক পুরনো সাক্ষাৎকারে জোহেব দাবি করেন, বিয়ের পর স্বামীর কাছে হেনস্থার শিকার হতেন নাজ়িয়া।
মির্জ়ার প্রথম স্ত্রী ছিলেন না নাজ়িয়া। নাজ়িয়াকে বিয়ে করার আগে ফিলিপিন্সের এক মডেল এবং পাকিস্তানের এক অভিনেত্রীকে বিয়ে করেছিলেন মির্জ়া। নাজ়িয়ার পরিবারের অভিযোগ, বিয়ের কথা গোপন করেছিলেন মির্জ়া।
নাজ়িয়া এবং মির্জ়ার সম্পর্ক ভাল ছিল না। বিয়ের বহু বছর পর মির্জ়ার দুই স্ত্রীর কথা জানতে পারেন নাজ়িয়া। নাজ়িয়া এবং তাঁর মা ব্রিটেনের হাই কোর্টে মির্জার বিরুদ্ধে বয়ানও দিয়েছিলেন। তাঁদের সম্পর্কের সত্য যেন প্রকাশ্যে না আসে সেই কারণে নাজ়িয়াকে নাকি নিয়মিত হুমকি দিতেন মির্জ়া।
নাজ়িয়ার পরিবারের অভিযোগ, ক্যানসারে আক্রান্ত হলেও নাজ়িয়ার মৃত্যুর কারণ আসলে মির্জ়া। মির্জ়াই নাকি খাবারের সঙ্গে প্রতি দিন বিষাক্ত পদার্থ মিশিয়ে অসুস্থ করে তুলেছিলেন নাজ়িয়াকে। ‘স্লো পয়জ়নিং’-এর কারণে নাজ়িয়ার মৃত্যু হয় বলে দাবি করে নাজ়িয়ার পরিবার।
নাজ়িয়ার মৃত্যুকে ঘিরে শুরু হয় তদন্ত। গায়িকা মারা যাওয়ার পরেও পাঁচ মাস সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছিল তাঁর মৃতদেহ। কিন্তু তদন্তের ফলাফল প্রকাশ্যে এলে জানা যায় ক্যানসারের কারণেই মৃত্যু হয়েছে নাজ়িয়ার।
১৪ বছর বয়সে কেরিয়ার শুরু করে বলিপাড়ার নামী সঙ্গীতশিল্পীদের তালিকায় নিজের নাম লিখিয়ে ফেলেছিলেন নাজ়িয়া। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁর অ্যালবামও বিক্রি হয়েছে প্রচুর। সমাজসেবার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি।
নাজ়িয়া না থাকলেও তাঁর গানগুলি এখনও বেঁচে রয়েছে। তাঁর গানগুলি নতুন ভাবে ব্যবহার করা হয় হিন্দি ছবিতে। নাজ়িয়ার জীবনের উপরের ভিত্তি করে কোনও ছবি বানানো হলে নাজ়িয়ার চরিত্রে অভিনয়ের ইচ্ছাপ্রকাশ করেছেন বলি অভিনেত্রী আলিয়া ভট্ট। এক পুরনো সাক্ষাৎকারে আলিয়া বলেন, ‘‘আমি নিজেও এক জন গায়িকা। কোনও দিন সুযোগ পেলে আমি নাজ়িয়ার চরিত্রে অভিনয় করতে চাইব।’’