কাজখাস্তানের রাজধানী আস্তানায় ‘সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজ়েশন (এসসিও)’-এর শীর্ষ সম্মেলনের আসর বসেছিল বৃহস্পতিবার। তার আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন প্রতিনিধি দেশের প্রধান এবং প্রতিনিধিরা।
ভারতও এসসিও-র সদস্য। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্মেলনে যোগ দেননি। গিয়েছিলেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। প্রধানমন্ত্রীর বার্তা দিয়ে এসেছেন তিনি।
পাকিস্তান এবং রাশিয়াও সেই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল। দুই দেশের প্রধানই এসসিও সম্মেলনে যোগ দিতে যান। একান্ত সাক্ষাৎকারেও বসেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
সেখানে দু’দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে দুই প্রধানের মধ্যে কথাও হয়। আর সেই বার্তালাপ চলাকালীনই নাকি পাকিস্তানের তরফে এমন বাণিজ্যিক প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তা শুনে হেসেই খুন রাশিয়া। এ নিয়ে বিভিন্ন গুঞ্জনও উঠেছে রাজনৈতিক মহলে।
প্রেসিডেন্ট পুতিনকে নাকি পাকিস্তানের সঙ্গে বিনিময় প্রথার প্রস্তাব দিয়ে এসেছেন শাহবাজ়। রাশিয়ার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন এই কথা উঠে এসেছে। আর তার পর থেকেই আবার প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে পাকিস্তানের ‘হাঁড়ির হাল’ নিয়ে।
বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈঠক চলাকালীন প্রথমেই পাকিস্তানে খনিজ তেল পাঠানোর জন্য পুতিনকে ধন্যবাদ জানান শাহবাজ। ভবিষ্যতেও যাতে রাশিয়ার তরফে পাকিস্তানে তেলের জোগান অব্যাহত থাকে, তা নিয়ে কথা হয়।
সেই সময়ই পুতিনকে নাকি বিনিময় প্রথার প্রস্তাব দিয়ে বসেছেন শাহবাজ়। পাশাপাশি, পঞ্চাশ এবং সত্তরের দশকে কী ভাবে দু’দেশের মধ্যে বিনিময় প্রথার মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য হত, তা-ও মনে করিয়ে দিয়েছেন। আর পাকিস্তানের এ হেন প্রস্তাবেই যথারীতি হাসির রব উঠেছে রাশিয়ার বিভিন্ন মহলে।
উল্লেখ্য, রাশিয়া এখনও পর্যন্ত পাকিস্তানে যা পণ্য রফতানি করেছে, তার বাজারমূল্য ১০০ কোটি ডলার। দু’দেশের মধ্যে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে এই অঙ্ককে আহামরি বলা চলে না। অথচ সেই টাকা মেটাতে গিয়েও প্রাচীন বিনিময় প্রথার দ্বারস্থ হতে হচ্ছে পাকিস্তানকে।
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বিগত প্রায় দু’বছর ধরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক হাল বেহাল। তাই নিজেদের ‘দারিদ্র’ ঢাকতেই রাশিয়াকে এমন প্রস্তাব দিয়েছে পাকিস্তান।
পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সঙ্কটের কথা এখন আর কারও অজানা নয়। বহু দিন ধরেই সে দেশ আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়েছে। তা থেকে বেরিয়ে আসার অনেক চেষ্টা করেও বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি ভারতের প্রতিবেশী।
তার মধ্যেই সেই দেশের সরকার উল্টেছে। ক্ষমতা গিয়েছে তদারকি সরকারের হাতে। নতুন সরকার গড়ার জন্য নির্বাচন হয়েছে। তার ফলঘোষণা হয়েছে। নতুন প্রধানমন্ত্রীও নির্বাচিত হয়েছে।
দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনৈতিক টানাপড়েনে জর্জরিত পাকিস্তান। ইসলামাবাদের মাথায় চেপেছে ঋণের পাহাড়প্রমাণ বোঝা। যার প্রভাব গিয়ে পড়েছে দেশের বাজারেও। পাকিস্তানে জিনিসপত্রের মূল্য মাঝেমধ্যেই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
ইসলামাবাদের একটি চিন্তন শিবিরের সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ, পাকিস্তানের অর্থনীতিতে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ ফেলেছে সে দেশের ঋণ-পরিস্থিতি। যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে খোদ আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার (আইএমএফ)।
পাকিস্তানের ঋণের বোঝার কারণে ইতিমধ্যেই সে দেশের শেয়ার বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
বিভিন্ন সমীক্ষার হিসাব বলছে, ২০১১ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে পাকিস্তানের মাথাপিছু ঋণ ৩৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়ের মধ্যে, পাকিস্তানের মাথাপিছু জিডিপি হ্রাস পেয়েছে ৬ শতাংশ।
পাকিস্তানে ঋণ এবং আয় বৃদ্ধির হারের মধ্যে বৈষম্যের কারণেও পাকিস্তান অর্থনীতির হাল খারাপ হয়েছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১১ সালে পাকিস্তানে এক জন শিশু মাথায় ৭০ হাজার পাকিস্তানি মুদ্রার ঋণ নিয়ে জন্ম নিত। ২০২৩ সালে সেই পরিমাণ ৩ লক্ষের বেশি।
বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১১ সাল থেকে, পাকিস্তানের বাহ্যিক ঋণ প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অভ্যন্তরীণ ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ছ’গুণ।
পাকিস্তানে বিদেশি মুদ্রার ভান্ডারও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কে পড়ে রয়েছে যৎসামান্য বিদেশি মুদ্রা। এই পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা দিয়ে ঠিক মতো আমদানি করা সম্ভব নয় বলেও সূত্রের খবর।
বিদেশি মুদ্রার খরচে লাগাম টানতে পাকিস্তান তাই আমদানি প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। তবে খনিজ তেলের আমদানি বজায় রেখেছে রাশিয়ার থেকে।
তবে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ভাবে খরচ করার মতো ১০০ কোটি ডলারও এখন পাকিস্তানের হাতে নেই। আর সেই কারণেই এই পরিস্থিতিতে পকেট বাঁচাতে নিজেদের ‘লজ্জা খুইয়ে’ বিনিময় প্রথার প্রস্তাব দিয়েছে পাকিস্তান।
আর পাকিস্তানের কাছে ব্যবসা করার মতো ১০০ কোটি ডলার নেই দেখে অবাক রাশিয়াও। তবে এই জন্য পাকিস্তান যে শেষমেশ বিনিময় প্রথার প্রস্তাব দিয়ে বসবে, তা-ও কল্পনা করতে পারেনি পুতিনের দেশ। আর তা নিয়েই উঠছে হাসির রোল।