নিদারুণ আর্থিক সঙ্কটে ভুগছে পাকিস্তান। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বেকারত্ব। এই অবস্থায় বিপুল স্বর্ণভান্ডারের হদিস মিলেছে বলে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করলেন সেখানকার প্রাক্তন খনিমন্ত্রী। ওই সোনা হাতে পেলে আর্থিক দিক থেকে ইসলামাবাদ যে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, তা বলাই বাহুল্য।
সম্প্রতি স্বর্ণভান্ডারের কথা ঘোষণা করেন পাক পঞ্জাব প্রদেশের সাবেক মন্ত্রী ইব্রাহিম হাসান মুরাদ। তিনি জানিয়েছেন, মাটির গভীরে লুকিয়ে আছে ২৮ লক্ষ তোলা (প্রায় ৩৩ টন) হলুদ ধাতু। পাকিস্তানি মুদ্রায় ওই সোনার বাজারমূল্য আনুমানিক ৮০ হাজার কোটি টাকা।
স্বর্ণভান্ডারের হদিস মেলার বিষয়টি এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) একটি পোস্টের মাধ্যমে দুনিয়ার সামনে আনেন পাক পঞ্জাবের সাবেক খনিমন্ত্রী মুরাদ। সেখানে তিনি লিখেছেন, ৩২ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে হলুদ ধাতুর খনি বিস্তৃত হয়ে রয়েছে। এর একটি প্রান্ত গিয়ে শেষ হয়েছে আটকে।
প্রাক্তন মন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, স্বর্ণভান্ডারের অস্তিত্বের বিষয়টি পাক ভূতাত্ত্বিক জরিপের (জিয়োলজিক্যাল সার্ভে অফ পাকিস্তান) বৈজ্ঞানিক রিপোর্টে উল্লেখ্য রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, পঞ্জাব প্রদেশে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ পাওয়ার সুযোগের কথাও বলেছে ওই সংস্থা।
মুরাদের দাবি, ‘‘মোট ১২৭টি এলাকা থেকে আলাদা আলাদা করে নমুনা সংগ্রহ করেন পাক ভূতাত্ত্বিক জরিপের কর্তা-ব্যক্তিরা। সেগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে স্বর্ণভান্ডার সংক্রান্ত রিপোর্ট তৈরি করেছেন তাঁরা। আগামী দিনে হলুদ ধাতুর উত্তোলন শুরু হলে, তা পাক অর্থনীতিতে নতুন মাইলফলক তৈরি করবে। কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে নানা ক্ষেত্রে নতুন মঞ্চ পাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।’’
ইসলামাবাদের জারি করা তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে পাকিস্তানে বেকারত্বের হার ১.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে সাত শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছে। দেশটির মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা জিডিপি) বৃদ্ধির হার স্বাস্থ্য বা শিক্ষা খাতে প্রয়োজনীয়তা পূরণের পক্ষে পর্যাপ্ত নয়।
বর্তমানে পাকিস্তানের বেকারত্বের হার ভারত বা বাংলাদেশের থেকে অনেক বেশি। সামাজিক ভাবে রক্ষণশীলতা থাকায় পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিতে মেয়েদের ঘরের বাইরে বেরিয়ে চাকরি বা ব্যবসা করা মোটেই সহজ নয়।
এআরওয়াই নিউজ় জানিয়েছে, প্রতি বছর ৫০ লক্ষ করে বাড়ছে পাকিস্তানের জনসংখ্যা। ফলে সেখানে বছরে ১৫ লক্ষ কর্মসংস্থানের প্রয়োজন রয়েছে। এ ব্যাপারে শাহবাজ শরিফ সরকারের কাছে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে পাকিস্তানের পরিকল্পনা কমিশন। সেখানে বলা হয়েছে যুবকদের বেকারত্বের হার কমাতে মুদ্রাস্ফীতি কমপক্ষে ছ’শতাংশ হ্রাস করতে হবে। মহিলাদের ক্ষেত্রে এই অঙ্ক দাঁড়াবে ১৭ শতাংশ।
গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) ২৯ নভেম্বর দুনিয়ার সবচেয়ে বড় হলুদ ধাতুর খনির হদিস মিলেছে বলে জানায় চিন। সেখানে লুকিয়ে থাকা সোনার পরিমাণ আনুমানিক হাজার টন বলে জানা গিয়েছে। চিনা সরকারি সংবাদমাধ্যমের দাবি, খনিতে লুকিয়ে থাকা হলুদ ধাতুর আনুমানিক বাজারদর ৮ হাজার ৩০০ কোটি ডলার।
এত দিন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বর্ণখনির মালিক ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। সেখানকার ‘সাউথ ডিপ’ খনিতে রয়েছে ৯০০ টন হলুদ ধাতু। এ বার সেই মুকুট বেজিংয়ের মাথায় উঠতে চলেছে।
চিনের হুনান প্রদেশের পিংজিয়াং কাউন্টিতে বিশ্বের সর্বাধিক বড় স্বর্ণখনিটি অবস্থিত বলে জানা গিয়েছে। স্থানীয় ভূতাত্ত্বিক ব্যুরো জানিয়েছে, মাটির নীচে মাত্র দু’কিলোমিটার গভীরতায় ছড়িয়ে আছে ৪০টি স্বর্ণ শিরা বা গোল্ড ভেন।
মাটির নীচে তাল তাল সোনা জমে যাওয়ার নেপথ্যে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। ভূবিজ্ঞানীদের দাবি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ভূপৃষ্ঠের ভিতরের পাথরের মধ্যে দিয়ে গলিত তরল সোনার স্রোত চলাচল করছে।
তরল অবস্থায় থাকায় হলুদ ধাতু ভূত্বকের ফাটলের ভিতর দিয়ে সঞ্চালিত হয়। পরবর্তী পর্যায়ে ওই তরল আশপাশের শিলা থেকে সোনা দ্রবীভূত করে। ফলে ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হয়ে তা ভূত্বকের নীচে জমাট বাঁধতে থাকে। এ ছাড়া চাপ ও তাপের পরিবর্তনের জেরেও তরল সোনা জমে যায় বলে জানিয়েছেন ভূবিজ্ঞানীরা।
হুনানের ভূতাত্ত্বিক ব্যুরোর অনুমান, শুধুমাত্র স্বর্ণ শিরা থেকেই ৩০০ মেট্রিক টন সোনা পাওয়া যেতে পারে। খনিতে হলুদ ধাতুর পরিমাণ জানতে ‘থ্রিডি মডেলিং’ পদ্ধতির সাহায্য নিয়েছিলেন তাঁরা।
সুপার কম্পিউটার পরিচালিত থ্রি ডি মডেলিং পদ্ধতিতে জানা গিয়েছে, খনির গভীরে অতিরিক্ত সোনা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর জন্য ভূগর্ভের তিন কিলোমিটার নীচে নামতে হতে পারে খনি শ্রমিকদের। একে অবশ্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছে ভূতাত্ত্বিকদের দল।
চিনা ভূতাত্ত্বিক ব্যুরোর পদস্থ কর্তা চেন রুলিন জানিয়েছেন, স্বর্ণখনির হদিস পেতে পাথুরে ভূপৃষ্ঠের কোর এলাকা খোদাই করতে হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘খনি থেকে তোলা প্রতি টন হলুদ ধাতু শোধন করলে ১৩৮ গ্রাম বিশুদ্ধ সোনা পাওয়া যাবে।’’
বিশেষজ্ঞদের বলেছেন, বেজিংয়ের দাবি সত্যি হলে হুনানের স্বর্ণ আকরিককে উৎকৃষ্ট মানের বলে স্বীকৃতি দিতে হবে। উল্লেখ্য, আকরিক শোধন করে ৮ গ্রাম বা তার বেশি সোনা পাওয়া গেলে এই তকমা দেওয়া হয়।
নতুন স্বর্ণখনির আবিষ্কার চিনা হলুদ ধাতুর শিল্পে বড় প্রভাব ফেলতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী স্বর্ণ উৎপাদনে ড্রাগনল্যান্ডের অবদান ১০ শতাংশ। গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) গোড়ায় বেজিংয়ের কাছে দু’হাজার টনের বেশি সোনা মজুত রয়েছে বলে খবর মেলে। এর উপর ভিত্তি করেই বিশ্বের স্বর্ণবাজারের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে চিন।
চিনের পর এ বার স্বর্ণভান্ডারের কথা জানালেন পাকিস্তানের মন্ত্রী। যদিও সেখান থেকে খনন কাজ কবে শুরু হবে, তা স্পষ্ট করেননি তিনি। ইসলামাবাদের তরফেও এই নিয়ে কোনও বিবৃতি দেওয়া হয়নি।