বাংলাদেশের ‘গর্ব’ পদ্মা সেতু। গত ২৫ জুন ও পার বাংলার ‘স্বপ্নের সেতু’র উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরের দিন, অর্থাৎ ২৬ জুন থেকেই যান চলাচল শুরু হয়েছে এই অত্যাধুনিক সেতুতে। এই সেতু তৈরি করে রীতিমতো চমকে দিয়েছে হাসিনা সরকার।
প্রথম থেকেই পদ্মা সেতু ঘিরে বাড়তি উন্মাদনা দেখা গিয়েছে ও পার বাংলার মানুষের মধ্যে। সেতুতে রেকর্ড হারে টোলও আদায় হয়েছে। জানা গিয়েছে, টোল বাবদ রোজ গড়ে দু’কোটি টাকা আয় হচ্ছে পদ্মা সেতুতে।
সেতুতে যান চলাচল শুরু হলেও পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ এখনও চলছে। এই পরিস্থিততে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম প্রথম আলো সূত্রে এমনটাই জানা গিয়েছে।
বর্তমানে পদ্মা সেতু প্রকল্পের মোট ব্যয় ধার্য করা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। জানা গিয়েছে, সংশোধনের পর ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৩২ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যয় বাড়ছে ২ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা।
পদ্মা সেতু প্রকল্প অনুমোদন পায় ২০০৭ সালে। সে সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গিয়েছে, ঠিকাদারের আয়ের উপর কর ও পণ্যের কর বৃদ্ধি, বাংলাদেশি টাকার সঙ্গে ডলারের বিনিময়ে মূল্যবৃদ্ধি, নদীবাঁধ ভাঙন, ফেরিঘাট স্থানান্তর, সেতুর জন্য যন্ত্রপাতি কেনা ও নকশায় কিছু সংশোধনের জন্য ব্যয় বেড়েছে।
কী কী কারণে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো দরকার, তার একটা তালিকা তৈরি করেছেন প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। বাড়তি যে ব্যয় ধরা হয়েছে, তার বেশির ভাগটাই খরচ হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে প্রকল্প সংশোধনের মাধ্যমে যা ব্যয়খাতে যোগ করা হচ্ছে। কিছু কাজ আগামী দিনে সম্পন্ন করা হবে। তার খরচ যোগ করে চূড়ান্ত সংশোধন করা হবে প্রকল্প প্রস্তাব।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের মেয়াদ আগামী জুন মাস পর্যন্ত। তবে নির্মাণকাজের মেয়াদ গত জুন মাসেই শেষ হয়েছে। ঠিকাদারদের বকেয়া মেটানোর কাজ চলছে। পাশাপাশি ছোটখাটো মেরামতির কাজ করা হচ্ছে। নদীবাঁধ মেরামতের কাজ নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন না হওয়ায় তা আরও এক বছর বাড়ানো হচ্ছে বলে খবর।
প্রকল্পের ডিরেক্টর শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, প্রকল্পের কোনও কোনও কাজে টাকা বেঁচে গিয়েছে। কিছু কাজে আবার অতিরিক্ত খরচ হয়েছে। বাড়তি ব্যয়ের একটা বড় অংশ সরকার কর হিসাবে পেয়েছে।
সেতু বিভাগ সূত্রে খবর, সরকারের কর বৃদ্ধির কারণে সবচেয়ে বেশি খরচ বেড়েছে। এতে প্রকল্পের খরচ বেড়েছে ৬৮৭ কোটি টাকা। মূল সেতু ও নদীবাঁধ মেরামতের কাজ করছে চিনের ঠিকাদার সংস্থা। প্রকল্পের জন্য ব্যবহৃত সামগ্রীর বড় অংশই চিনের। বিদেশি পণ্য কেনার খরচ ডলারে শোধ করতে হয়েছে। ডলারের দাম বেড়েছে। ফলে বেড়েছে খরচ।
নির্মাণকাজের তদারকি করছে দক্ষিণ কোরিয়ার কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে কর্পোরেশন। ওই সংস্থার পরামর্শদাতাদের অধিকাংশই বিদেশি। ২০১৪ সালের নভেম্বরে ওই সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কাজের জন্য সংস্থার মেয়াদ ধার্য করা হয়েছিল ২০১৯ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত। কিন্তু সময়মতো কাজ শেষ না হওয়ায় ওই প্রতিষ্ঠানের জন্য এখনও খরচ বইতে হচ্ছে। এর ফলে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধি হয়েছে।
পদ্মা সেতুর ভাটিতে বিদ্যুতের লাইন রয়েছে। যার খরচ দেওয়া হচ্ছে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে। এই কাজের জন্য প্রথমে যে খরচ ধরা হয়েছিল, তার থেকে আরও প্রায় ৪০০ কোটি টাকার মতো খরচ করতে হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
যান চলাচল শুরুর পর সেতুতে বেশ কিছু যন্ত্র, অপটিক ফাইবার কেবল বসানোর কাজ চলছে। সেই সঙ্গে টোল প্লাজার কাছে বাস বে তৈরি, ট্রাকের জন্য আলাদা লেন তৈরির কাজও প্রকল্পের টাকা থেকে করা হচ্ছে। এই খাতে ব্যয় বেড়েছে ২১৫ কোটি টাকা।
নদীবাঁধ মেরামতের জন্য ৮০০ কেজি ওজনের বিশেষ ব্যাগ ফেলা হয়েছে। প্রকল্প কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছে, এই কাজের শুরুতে যে আকারের ব্যাগ ফেলার কথা ছিল, পরে তার আকার বাড়ানো হয়েছে। এ জন্য প্রায় ১৩০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হয়েছে।
পদ্মা সেতু তৈরিতে যে সব যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলি নিয়ে একটি সংগ্রহশালা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই মতো, ঠিকাদার সংস্থার থেকে বেশ কিছু সামগ্রী কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ জন্য বাড়তি খরচ হচ্ছে।
সেতু তৈরির জন্য মাওয়া ও কাঁঠালবাড়িতে ফেরিঘাট স্থানান্তর করতে হয়েছে। এ জন্য বাড়তি খরচ হয়েছে। পাশাপাশি ভাঙনের মুখে মাওয়া ফেরিঘাট। তা মেরামত করা হয়েছে। এ সব কাজের জন্য প্রকল্প থেকে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
জাঁকজমক করে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করা হয়েছিল। মাওয়া ও জাজিরায় মূল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছিল। পাশাপাশি সমস্ত জেলায় আতশবাজি পোড়ানো-সহ নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। এ জন্য যা খরচ হয়েছে, তা নেওয়া হয়েছে সেতু প্রকল্পের টাকা থেকে। এ জন্য ৮৯ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালে আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় আসার পর পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ শুরু হয়। ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া পয়েন্টে আনুষ্ঠানিক ভাবে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন হাসিনা।
পদ্মা সেতুর নকশা তাক লাগিয়েছে বিশ্বকে। এই সেতুটি গড়তে নিজেদের পরিশ্রম উজাড় করে দিয়েছেন দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ২৪ লাইভ নিউজপেপারের তথ্য অনুযায়ী, পদ্মা সেতু তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দামি সিমেন্ট। পদ্মা সেতুর নীচ দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে রেলপথ। সেখান দিয়ে ছুটবে ট্রেন।
জানা গিয়েছে, পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য (জলের অংশ) ৬.১৫ কিমি। স্থলভাগের অংশ ধরে সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য ৯ কিমির বেশি। সেতু নির্মাণের কাজ পেয়েছিল চিনের মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং। পদ্মা নদীর দুই পাড়ের সংযোগ (সড়ক ও সার্ভিস এরিয়া) তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশি সংস্থা আব্দুল মোনেম লিমিটেডকে। মালয়েশিয়ার একটি সংস্থার সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা কাজ করেছে।
পদ্মা সেতু নিয়ে সে দেশে সরকারে সমালোচনায় সরব হয়েছিল বিরোধীরা। সমালোচনা হয়েছিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের খরচ নিয়েও। এই বিতর্কের মধ্যেই সেতু প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধির বিষয়টি প্রকাশ্যে আসায় চর্চা শুরু হয়েছে।