ইচ্ছা আর মনের অদম্য জেদ এক সামান্য মানুষকে যে অসাধারণ উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারে, এমন উদাহরণ আমাদের সমাজে অনেক পাওয়া যায়। কিন্তু তার মধ্যেও এমন অনেকে আছেন যাঁদের জীবনকাহিনি ব্যতিক্রম হয়েই থেকে যায়। তেমনই এক জন হলেন মনোজ শর্মা।
কী ভাবে একটি দ্বাদশ অনুত্তীর্ণ ছেলের জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল একটি ঘটনায়, তারই বর্ণনা করেছেন মনোজের এক বন্ধু অনুরাগ পাঠক। বইটির শীর্ষক ‘টুয়েলফথ ফেল, হারা ওহি জো লড়া নেহি’।
সবাই যখন মনোজের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেছিল, এক জনই তাঁর পাশে ছিলেন। তাঁকে সব সময় সাহস জুগিয়ে গিয়েছেন। তিনি আর কেউ নন, মনোজের প্রেমিকা।
পড়াশোনায় খুব একটা ভাল ছিলেন না মনোজ। বন্ধুর লেখা বইতে মনোজ জানিয়েছেন, নবম, দশম এবং একাদশ শ্রেণি নকল করে পাশ করেছেন। কিন্তু দ্বাদশ শ্রেণিতে টুকলির উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ায় পাশ করে ওঠা সম্ভব হয়নি।
মনোজ বলেন, “ভেবেছিলাম টুকলি করে কোনও রকমে দ্বাদশ উতরে যাব। তার পর টাইপিং শিখে কোথাও না কোথাও একটা কাজ জুটিয়ে নেব। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি।”
অবিভক্ত মধ্যপ্রদেশের মুরেনা জেলায় জন্ম মনোজের। ‘টুয়েলফথ ফেল, হারা ওহি জো লড়া নেহি’ শীর্ষক বইটিতে মনোজের ছাত্রজীবন থেকে আইপিএস হওয়ার কাহিনি উঠে এসেছে। যা অত্যন্ত প্রেরণাদায়ক।
পরীক্ষায় নকলে মহকুমাশাসকের কড়া নির্দেশের কারণে মনোজের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর কথায়, “টুকলি করতে না পেরে ভেবেছিলাম, এমন কোন ক্ষমতাবান ব্যক্তি যাঁর নির্দেশে টুকলি বন্ধ করে দেওয়া হল? সেই সময় থেকেই সিদ্ধান্ত নিই, কোনও কিছু যদি করতেই হয়, তা হলে জেলাশাসকের মতো ক্ষমতাবান ব্যক্তিই হব।”
দ্বাদশ অনুত্তীর্ণ হওয়ার পর দাদার সঙ্গে কাজে ঢোকেন। টেম্পো চালানো শুরু করেন মনোজ। কিন্তু এক দিন পুলিশ টেম্পো আটক করায় মনোজ সোজা চলে গিয়েছিলেন মহকুমাশাসকের দফতরে। তাঁর মনে হয়েছিল যে, মহকুমাশাসকই তাঁর টেম্পো ছেড়ে দিতে সহযোগিতা করবেন।
মনোজ বলেন, “মহকুমাশাসকের কাছে যে কাজের জন্য গিয়েছিলাম, সেই কাজের কথা দূরে সরিয়ে রেখে মহকুমাশাসক হতে গেলে কী ভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়, সেই কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তাঁর কথা শোনার পর স্থির করেছিলাম আমাকে মহকুমাশাসকই হতে হবে।”
এর পর বাড়ি থেকে জামাকাপড় নিয়ে গ্বালিয়রে চলে এসেছিলেন মনোজ। নতুন শহর। নতুন লোক। হাতে বিশেষ টাকাপয়সাও ছিল না। ফলে রাতে ভিখারিদের পাশেই শুয়ে পড়তেন। খাবারও জুটত না সব সময়।
কিন্তু এ ভাবে বেশি দিন কাটাতে হয়নি। ভাগ্যদেবী প্রসন্ন হয়েছিলেন তাঁর প্রতি। কয়েক দিনের মধ্যেই লাইব্রেরিয়ানের কাজ পেয়ে গিয়েছিলেন। পিওনেরও কাজ করতেন তাঁর পাশাপাশি।
মনোজ বলেন, “তাঁর জীবনে দু’জনের বই খুব প্রভাব ফেলেছিল। এক জন হলেন ম্যাক্সিম গোর্কি এবং অন্য জন হলেন, আব্রাহম লিঙ্কন। আর এই দু’জনের ভাবধারাই আমার জীবন বদলে দিতে সাহায্য করেছিল।”
এর পরই দিল্লিতে চলে আসেন। বিত্তশালী বেশ কয়েকটি পরিবারের পোষ্য কুকুরের দেখাশোনার কাজ করেন মাসিক ৪০০ টাকার বিনিময়ে।
সেই টাকা দিয়েই পড়া শুরু করেন মনোজ। কলেজ উত্তীর্ণ হওয়ার পর পুলিশের পরীক্ষায় বসেন। প্রথম প্রচেষ্টায় প্রিলিমিনারি পাশ করেন। কিন্তু চূড়ান্ত পরীক্ষায় ব্যর্থ হন।
মনোজ বলেন, “প্রেমিকাকে বলেছিলাম, তুমি যদি আমার সঙ্গ দাও, তা হলে দুনিয়া বদলে দেব।” না, প্রেমিকা মুখ ফেরাননি। বরং সাহস জুগিয়েছেন। আর সেই সাহসে ভর করে চতুর্থ বারের চেষ্টায় আইপিএস পরীক্ষায় পাশ করেন মনোজ।
২০০৫ সালে মহারাষ্ট্র ক্যাডারের আইপিএস হন মনোজ। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হিসাবে মহারাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলে নিযুক্ত হন।