দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে শান্তিরক্ষার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছিল রাষ্ট্রপুঞ্জ। সেই আন্তর্জাতিক সংগঠনের পাঁচটি প্রধান স্থায়ী সদস্য দেশ আমেরিকা, রাশিয়া, চিন, ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স। পরমাণু যুদ্ধ হলে তার ফলাফলের বিষয়ে তারা প্রত্যেকেই একমত।
২০২১ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জে আমেরিকা, চিন-সহ পাঁচ দেশই বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল, ‘‘পরমাণু যুদ্ধে জেতা অসম্ভব। তাই এই যুদ্ধ কখনও করাই উচিত নয়।’’ অর্থাৎ, পরমাণু যুদ্ধ থেকে বিরত থাকাই তাদের লক্ষ্য।
কিন্তু রাষ্ট্রপুঞ্জের বিবৃতিতে যাই বলা হোক না কেন, তার পরেই যুদ্ধের দামামা বেজেছে পূর্ব ইউরোপে। ২০২২ সালে ইউক্রেন আক্রমণ করেছে রাশিয়া। সে যুদ্ধের দাপটে এখনও বিষাক্ত ইউরোপের বাতাস।
ইউক্রেনে যুদ্ধের এই সিদ্ধান্ত রাশিয়াকে পশ্চিমি দুনিয়ার রোষের মুখে ফেলেছিল। এর ফলে বিশ্ব শান্তি যেমন বিঘ্নিত হয়েছে, তেমন রাষ্ট্রপুঞ্জের সদস্য দেশগুলির পারস্পরিক নির্ভরযোগ্যতাও টলে গিয়েছে।
ফলে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তৎপরবর্তী আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সমগ্র বিশ্বকে আবার বড়সড় একটি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের একাংশের। এ বার যুদ্ধে হলে তাতে অবশ্যই ব্যবহার করা হবে পারমাণবিক অস্ত্র। যাতে সামগ্রিক ধ্বংস নিশ্চিত।
এই মুহূর্তে কোন কোন দেশের হাতে পরমাণু অস্ত্র আছে? তার সংখ্যাই বা কত? পরমাণু শক্তিধর দেশগুলির মধ্যে শীর্ষে কার অবস্থান? তালিকায় ভারত কত নম্বরে? আন্তর্জাতিক রাজনীতির সাম্প্রতিক প্রেক্ষিতে এই তথ্য জেনে রাখা জরুরি।
দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, সারা বিশ্বে এই মুহূর্তে ১২,৫১২টি পরমাণু অস্ত্র রয়েছে। তার মধ্যে ৯,৫৭৬টি যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত। যে কোনও সময় উপযুক্ত সামরিক প্রস্তুতির মাধ্যমে এই অস্ত্র প্রয়োগ করা যেতে পারে।
দ্য স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) জানিয়েছে, সারা বিশ্বে মজুত ১২ হাজারের বেশি পরমাণু অস্ত্রের মধ্যে ৩,৮৪৪টি কোনও না কোনও মিসাইল বা বিমানের মাধ্যমে প্রয়োগ করতে হয়।
এই পরমাণু অস্ত্রগুলির মধ্যে অন্তত ৮৬টি একেবারে নতুন। সাম্প্রতিক সময়ে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেগুলি তৈরি করা হয়েছে। ৮৬টি নতুন অস্ত্রের মধ্যে ৬০টিই চিনের দখলে।
এ ছাড়া, নতুন অস্ত্রগুলির মধ্যে রাশিয়ায় আছে ১২টি, পাকিস্তানে আছে ৫টি, উত্তর কোরিয়ায় আছে ৫টি এবং ভারতে আছে ৪টি পরমাণু অস্ত্র।
২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসের পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে পরমাণু অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ভান্ডার রয়েছে রাশিয়ায়। তাদের কাছে বর্তমানে ৪,৪৮৯টি যুদ্ধে ব্যবহারযোগ্য অস্ত্র আছে।
তালিকায় এর পরেই আমেরিকা। তাদের কাছে আছে মোট ৩,৭০৮টি পরমাণু অস্ত্র। মোট অস্ত্রভান্ডারের ৯০ শতাংশই এই দুই শক্তিধর দেশের অধীনে।
বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পরমাণু শক্তিধর দেশ চিন। তাদের পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা ৪১০। গত জানুয়ারিতে তাদের কাছে ৩৫০টি পরমাণু অস্ত্র ছিল। এক বছরে অস্ত্রের সংখ্যা অনেকটা বাড়িয়ে ফেলেছে চিন।
ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের কাছে যথাক্রমে ২৯০ এবং ২২৫টি পরমাণু অস্ত্র রয়েছে। ব্রিটেন এই সংখ্যা বৃদ্ধি করে ২৬০-এ নিয়ে যাবে বলে জানিয়েছে। একই সঙ্গে তারা জানিয়ে দিয়েছে, বিশ্ব রাজনীতির সাম্প্রতিক গম্ভীর পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে আগামী দিনে তারা নিজেদের অস্ত্রের ভান্ডার গোপনে রাখবে।
পাকিস্তান বরাবর ভারতকে টেক্কা দেওয়ার জন্য তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে জোর দিয়ে এসেছে। তাদের কাছে ১৭০টি পরমাণু অস্ত্র রয়েছে বলে খবর। যা ভারতের চেয়ে কিছুটা হলেও বেশি।
ভারতের কাছে এই মুহূর্তে মজুত পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা ১৬৪। বিশ্ব তালিকায় ভারত রয়েছে সপ্তম স্থানে, পাকিস্তানের ঠিক পরে। তার পরে ইজ়রায়েল (৯০টি) এবং উত্তর কোরিয়ার (৩০টি) অবস্থান।
এসআইপিআরআই জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট দেশগুলির তথ্য অনুযায়ী এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে বিশ্ব রাজনীতিতে গোপনীয়তা অনেক বেড়ে গিয়েছে। তাই দেশগুলির তরফে সঠিক তথ্য দেওয়া হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত নয়।
চিনের পরমাণু অস্ত্র সংক্রান্ত তৎপরতা বিশেষজ্ঞদের চিন্তায় রেখেছে। তারা যে হারে এই অস্ত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি করে চলেছে, তাতে ২০৩৫ সালের মধ্যে তাদের হাতে ১৫০০টি পরমাণু অস্ত্র চলে আসতে পারে বলে অনুমান।
চিন তার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মাটির নীচে পরমাণু অস্ত্রাগার তৈরি করা শুরু করেছে। সেই সঙ্গে মহাকাশ বিজ্ঞানেও গত কয়েক বছরে চোখে পড়ার মতো তৎপরতা দেখিয়েছে বেজিং।
ভারতের বিরুদ্ধে প্রায়ই চিন তার মিত্র দেশ পাকিস্তানকে ব্যবহার করে থাকে। এই পাকিস্তানও সামরিক দিক থেকে যথেষ্ট শক্তিশালী। চিন এবং পাকিস্তানের সম্মিলিত শক্তির সামনে ভারত পরিসংখ্যানগত দিক থেকে অনেক পিছিয়ে।
সামরিক বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, পরিসংখ্যান নয়, চিনকে টেক্কা দিতে হলে ভারতের প্রয়োজন প্রযুক্তি এবং কূটনীতিতে বেশি জোর দেওয়া। তবেই ভবিষ্যতে বিপদ এড়াতে পারবে নয়াদিল্লি।