আমেরিকায় ফ্রেঞ্চ হর্ন বাদ্যকারদের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় নাম এলিয়ট হিগ্গিনস্। সত্তরের দশকে বাজনদারদের মাঝে জনপ্রিয়তা কুড়িয়েছিলেন তিনি। এই বিশেষ বাদ্যযন্ত্রটিকে কেন্দ্র করে নানা প্রতিযোগিতা, প্রদর্শনী এবং অনুষ্ঠানের জন্ম দেন এলিয়ট।
মাথায় সাদা চুল, লালচে গাল, গৌরবর্ণ এই যুবক ফ্রেঞ্চ হর্ন হাতে সকলের মন জয় করে নিয়েছিলেন সহজেই। ছোটদের ফ্রেঞ্চ হর্ন বাজানো শিখিয়েওছেন তিনি। কিন্তু এই আপাত সদাহাস্যময় চেহারার অন্তরালে লুকিয়েছিল এক নৃশংস, পৈশাচিক সত্তা।
এলিয়টের চরিত্রের এই গোপনীয়তায় মোড়া দিকটি প্রকাশ্যে আসে প্রায় তিন দশক পর। তত দিনে কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ করার জন্য তিনি আর জীবিত নেই। জীবদ্দশায় পুলিশের চোখের সামনেই হেসেখেলে দিন কাটিয়েছেন এলিয়ট।
১৯৯১, ২০০১, ২০০৪। আমেরিকার বুকে এই তিন বছরে তিনটি ধর্ষণ এবং যৌন হেনস্থার রহস্যজনক ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল গোয়েন্দাদের। কিছুতেই তাঁরা এই অপরাধের নেপথ্য কাণ্ডারিকে ধরতে পারছিলেন না। অথচ, তাঁদের নাকের ডগাতেই ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন আসল অপরাধী।
তিনটি অপরাধের প্রেক্ষাপটই আমেরিকার আলাবামা প্রদেশের তুস্কালুসা শহর। সেখানেই ফ্রেঞ্চ হর্নবাদকের যৌন লালসার শিকার হন একের পর মহিলা। কিন্তু সুকৌশলে পুলিশের নজর এড়িয়ে গিয়েছেন এলিয়ট।
পুলিশ জানিয়েছে, ১৯৯১ সালের কোনও এক গ্রীষ্মের রাতে যৌন হেনস্থার শিকার হন আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী। এক ব্যক্তি তাঁকে জোর করে গাড়িতে তোলেন। তার পর গলায় চেপে ধরা হয় ধারালো ছুরি।
তরুণীর গলায় ছুরি চেপে ধরে তাঁকে ধর্ষণ করেন অভিযুক্ত। তার পর এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। পুলিশকে তরুণী যুবকের যে বর্ণনা দিতে পেরেছিলেন, তা থেকে কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।
তুস্কালুসা কাউন্টি ভায়োলেন্স ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ক্যাপ্টেন জ্যাক কেনেডি অভিযুক্তকে খুঁজে বার করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। কিন্তু শত চেষ্টা করেও সে সময় এলিয়টকে ধরা যায়নি।
এক দশক পর, ওই শহরেই আবার অনুরূপ ঘটনা ঘটে। তুস্কালুসার এক তরুণীর গলায় ছুরি চেপে ধরে ধর্ষণ করা হয়। তরুণী পেশায় ছিলেন রিয়েল এস্টেট এজেন্ট।
পুলিশকে তিনি জানান, এক ভদ্রলোক তাঁকে ফোন করে বাড়ি সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলার জন্য ডেকে পাঠান। তিনি জানিয়েছিলেন, স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে শহরে তিনি নতুন এসেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিও পেয়েছেন।
তলব পেয়ে নির্দিষ্ট স্থানে হাজির হন তরুণী। অভিযোগ, সেখানে তাঁর গলায় ধারালো ছুরি চেপে ধরে যৌন হেনস্থা করা হয়। অভিযুক্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে পুলিশকে তরুণী জানান, তিনি ছিলেন বয়স্ক। তার মাথায় টাক ছিল এবং ফর্সা গালে ছিল লালচে আভা।
এ বারেও তদন্তে নামেন জ্যাক কেনেডি। কিন্তু অভিযুক্তকে ধরা দূরের কথা, তাঁকে চিহ্নিতও করতে পারেনি পুলিশ। ১৯৯১ সালের ঘটনায় ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা গিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী ক্ষেত্রে তা-ও মেলেনি।
২০০৪ সালে, অপেক্ষাকৃত উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে রহস্য সমাধানে নতুন দিশা পান তদন্তকারীরা। ল্যাবরেটরিতে নমুনা নমুনা জমা দেওয়া হয়। বছর দু’য়েক পরে ল্যাব কর্তৃপক্ষ কেনেডিকে জানান, ওই ডিএনএ নমুনা অনুরূপ আরও একটি অপরাধের নমুনার সঙ্গে মিলে গিয়েছে।
তৃতীয় ঘটনায় নির্যাতিতা তরুণী পুলিশকে জানান, কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে তিনি বিয়ের পোশাক বিক্রি করছিলেন। সেই বিজ্ঞাপনের সূত্রে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন এক ব্যক্তি। তার পর পিস্তল দেখিয়ে জোর করে তাঁর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়ার চেষ্টা করেন।
এ ক্ষেত্রেও, অভিযুক্তের বর্ণনায় টাক মাথা, লালচে গাল এবং বয়সের চিহ্নগুলি মিলে গিয়েছিল আগের নির্যাতিতার বয়ানের সঙ্গে। ফলে তিনটি ঘটনাই যে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত এবং এগুলির নেপথ্যে যে এক জনই রয়েছে, বুঝতে বাকি ছিল না পুলিশের।
অভিযুক্ত ধরা পড়েননি। দীর্ঘ ১৫ বছর কেটে যায়। মামলাগুলিও ধামাচাপা পড়ে যায় সময়ের নিয়মে। কিন্তু কেনেডি হাল ছাড়েননি। ২০২১ সালে জেনেটিক জিনোলজি প্রযুক্তির সাহায্য নেন তিনি।
নতুন করে ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখা যায়, তুস্কালুসায় তিনটি ধর্ষণ এবং যৌন হেনস্থার ঘটনার নেপথ্যে রয়েছেন জনপ্রিয় ফ্রেঞ্চ হর্নবাদক এলিয়ট। কিন্তু অপরাধীর নাম জানা গেলেও তাঁকে শাস্তি দেওয়ার উপায় আর পুলিশের হাতে ছিল না।
কারণ এলিয়টের মৃত্যু হয়েছে ২০১৪ সালে। ৭৩ বছর বয়সে মারা গিয়েছেন তিনি। জীবদ্দশায় কেউ তাঁর গোপন রূপটি জানতে পারেননি।
বাবার কীর্তি শুনে হতাশায় ভেঙে পড়েন এলিয়টের কন্যা অ্যাম্বার। এক দিকে জন্মদাতার প্রতি ক্ষোভ, ঘৃণা, অন্য দিকে সামাজিক সম্মানহানিতে জর্জরিত হন তিনি। তবে তদন্তকারীদের সাহায্য করবেন বলেও আশ্বাস দেন।
পুলিশের অনুমান, আরও অনেকেই এলিয়টের লালসার শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু লজ্জা এবং সম্মানহানির কারণে সকলে তা প্রকাশ্যে আনতে পারেননি। তাঁর কীর্তির কথা জানাজানি হওয়ার পর ফ্রেঞ্চ হর্নের দুনিয়াতেও নিমেষে অর্জিত গৌরব খোয়াতে হয়েছে এলিয়টকে।