Doomsday Vault

সোনাদানা নয়, রয়েছে ১২ লক্ষের বেশি অনন্য সম্পদ! ‘শেষের সে দিনের’ জন্য প্রস্তুত ‘ডুমসডে ভল্ট’

এই ভল্টে সোনাদানা, হিরেজহরত, কয়লা বা তেলের ভান্ডার লুকোনো নেই। বদলে রয়েছে বাক্সবন্দি লক্ষ লক্ষ খাদ্যশস্যের বীজ।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
অসলো শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৭:৩৯
Share:
০১ ২১

যে দিকে চোখ যায়, নজরে পড়ে বরফে মোড়া শূন্যতা। তার মাঝে মাথা উঁচিয়ে রয়েছে একটি আয়তাকার বিল্ডিংয়ের একাংশ। যার পিছনের অংশটি বরফের নীচে ডুবে রয়েছে। নরওয়ের স্বোয়ালবার্ড দ্বীপপুঞ্জে ওই বিল্ডিংটি আসলে আস্ত একটি ভল্ট। তবে এই ভল্টে সোনাদানা, হিরেজহরত, কয়লা বা তেলের ভান্ডার লুকোনো নেই। বদলে রয়েছে বাক্সবন্দি লক্ষ লক্ষ খাদ্যশস্যে র বীজ

০২ ২১

সুমেরু বৃত্তের কাছে ওই ভল্টের পোশাকি নাম ‘স্বোয়ালবার্ড গ্লোবাল সিড ভল্ট’। ভবিষ্যতের ধরিত্রীতে খাদ্যসুরক্ষার অভাব দেখা দিলে যেটির দরজা খুলে দেওয়া হতে পারে। যে ভল্টে রাখা ১২ লক্ষের বেশি শস্যবীজের নমুনা থেকে তৈরি করা যেতে পারে ফসল।

Advertisement
০৩ ২১

ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই তৈরি করা হয়েছে এই ভল্ট। নরওয়ে সরকারের হাতে গড়া এই ভবনে রয়েছে মানব ইতিহাসের ১৩,০০০ বছরের কৃষিকাজের ফসল।

০৪ ২১

এতে রয়েছে ভারত-সহ বিশ্বের নানা দেশ থেকে সংগৃহীত অসংখ্য বীজের ৯৯টি জিনব্যাঙ্ক। সংরক্ষিত করা হয়েছে ৬,১২০ প্রজাতির শস্যবীজের নমুনা। রয়েছে ৯,৩০,০০০ শস্যদানা। শুধুমাত্র চালের নমুনাই রয়েছে ২ লক্ষ ধরনের। এবং এই সংখ্যাটি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

০৫ ২১

স্বোয়ালবার্ড দ্বীপপুঞ্জের পাহাড়ের কোলে এই ভল্টের প্রয়োজন পড়ল কেন? এর উত্তর লুকিয়ে রয়েছে আধুনিক সভ্যতার ‘অভিশাপে’। গত ৫০ বছরে বিশ্ব জুড়েই কৃষিকাজের পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন হয়েছে। প্রযুক্তির উপর ভর করে ফসল ফলানোর কাজ শুরু হওয়ায় খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও তা আঘাত হেনেছে জীববৈচিত্রে।

০৬ ২১

আমেরিকার সংবাদমাধ্যম ‘টাইম’-এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফলন বৃদ্ধি পেলেও গোটা বিশ্বে মানুষের খাদ্যের চাহিদার ৯৫ শতাংশ মেটাতে পারে মাত্র ৩০টি ফসল। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, গত শতকের পঞ্চাশের দশকে উৎপাদিত ধানের বীজের মধ্যে মোটে ১০ শতাংশ এখনও ফসল হিসাবে ফলানো যায়।

০৭ ২১

এ হেন উদাহরণ আরও রয়েছে। ১৯০০ সালের গোড়া থেকে আজ পর্যন্ত ৯০ শতাংশের বেশি শাকসব্জি এবং ফলের প্রজাতি হারিয়ে ফেলেছে আমেরিকা। খরা বা ফসলের রোগব্যাধির থেকেও উৎপাদনের ক্ষেত্রে থাবা বসিয়েছে একচেটিয়া পদ্ধতিতে কৃষিকাজ।

০৮ ২১

আধুনিক সভ্যতার এই ‘অভিশাপেই’ ভবিষ্যতে খাদ্যসুরক্ষায় অভাব দেখা দিতে পারে। মূলত সেই আশঙ্কা থেকেই শস্যদানার বীজ সংরক্ষণের চিন্তাভাবনার শুরু। যাতে ভবিষ্যতে কোনও সময় প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যুদ্ধ বা অতিমারির প্রকোপে শস্যের প্রজাতিগুলি চিরতরে বিনষ্ট হয়ে গেলেও কৃষিকাজ চালিয়ে যাওয়া যায়।

০৯ ২১

‘স্বোয়ালবার্ড গ্লোবাল সিড ভল্ট’-এর ভাবনা শুরু হয়েছিল আশির দশকে। ১৯৮৪ সালে নরওয়ের লংগিয়ারবায়েন এলাকায় অদূরে একটি পরিত্যক্ত কয়লাখনিতে নানা শস্যের হিমায়িত বীজের নমুনা সংরক্ষিত করতে শুরু করে নর্ডিক জিনব্যাঙ্ক (বর্তমানের নর্ডজেন)।

১০ ২১

আশির দশকে এই ভল্ট গঠনের পক্ষে দীর্ঘ দিন ধরে সওয়াল করেছেন আমেরিকার সংরক্ষণবিদ তথা ‘গ্লোবাল ক্রপ ডাইভার্সিটি ট্রাস্ট’ (ক্রপ ট্রাস্ট)-এর প্রাক্তন এগ‌জ়িকিউটিভ ডিরেক্টর ক্যারি ফাওলার-সহ সিডিআইএআর নামে খাদ্যসুরক্ষা নিয়ে গবেষণাকারী এক আন্তর্জাতিক সংগঠন। এ বিষয়ে নরওয়ে সরকারের কাছেও দরবার করেন ফাওলাররা।

১১ ২১

ভল্ট গঠনের বাস্তবায়ন নিয়ে ২০০৪ সালে একটি সমীক্ষা হয়। তার আগে ২০০১ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের মধ্যস্থতায় একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এর পর স্বোয়ালবার্ডে সেটি গড়ে তোলায় মনোনিবেশ করে নরওয়ে সরকার।

১২ ২১

চার বছর পর ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছিল। যদিও উদ্বোধনের আগের মাসেই সেখানে প্রথম শস্যদানার বীজ পৌঁছে গিয়েছিল।

১৩ ২১

৭২ কোটির বেশি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই ভবনে যে সম্পদ রয়েছে, তার অর্থকরী মূল্য নামমাত্র। তবে এখানকার প্রতিটি বাক্সে রয়েছে ভবিষ্যতের খাদ্যসুরক্ষার চাবিকাঠি। সে কারণে অনেকেই এর নাম রেখেছেন ‘ডুমসডে ভল্ট’।

১৪ ২১

নরওয়ে ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, মেক্সিকো, সিরিয়া, চিন, আমেরিকা-সহ বিশ্বের নানা দেশের শস্যবীজের নমুনা হিমায়িত রয়েছে এই ভল্টে।

১৫ ২১

স্বোয়ালবার্ডের বরফে ঢাকা প্রান্তরে ভল্টের প্রবেশপথ রয়েছে একটি আয়তাকার বিল্ডিংয়ে। সাধারণের জন্য যার দরজা সব সময়ই বন্ধ থাকে। তবে এর ১৫তম বর্ষপূর্তিতে উৎসাহীদের জন্য ভার্চুয়াল ট্যুরের বন্দোবস্ত করেছিল নরওয়ে সরকার।

১৬ ২১

প্রবেশপথের দরজা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলে নজরে পড়ে একটি সংক্ষিপ্ত সুড়ঙ্গ। যেখানে পা রাখলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণকারী যন্ত্রের বৈদ্যুতিন আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। গোটা সুড়ঙ্গপথটি অসংখ্য আলোয় জ্বলজ্বল করে।

১৭ ২১

কংক্রিটের সেই সুড়ঙ্গপথে এগোতে থাকলে ৪৩০ ফুট গভীরে চলে যাওয়া যায়। সুড়ঙ্গের শেষে গিয়ে নজরে পড়বে কয়েকটি দরজা। তার মধ্যে একটি দরজা খুলে পৌঁছে যাওয়া যায় মূল চেম্বারে। সেই চেম্বারে তিনটি ভল্ট রয়েছে। তার মাঝের ভল্টটিতে হিমায়িত বীজগুলি রাখা রয়েছে।

১৮ ২১

মূল ভল্টের দরজাটি সব সময় বরফের পুরু স্তরে মোড়া থাকে। শস্যদানা সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ভল্টের ভিতরের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস নীচে রাখা হয়। সেখানে মাটি থেকে ছাদ পর্যন্ত অজস্র তাকে রয়েছে অসংখ্য রুপোর প্যাকেট। সেগুলির প্রতিটিই বায়ুনিরোধক।

১৯ ২১

বিশ্ব জুড়ে এ ধরনের ১,৭০০ জিনব্যাঙ্ক বা ভল্ট রয়েছে। নতুন ধরনের বীজ তৈরির কাজে, সংরক্ষণ করার জন্য এবং গবেষণার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্তরে বীজের আদানপ্রদানও হয়। তবে নরওয়ের এই ভল্টটিকে ঘিরে এত উৎসাহী কেন বিশ্ববাসী? ক্রপ ট্রাস্টের প্রধান পার্টনারশিপ কো-অর্ডিনেটর ব্রায়ান লেইনফ বলেন, ‘‘এই ভল্টের ভিতরে ১৩,০০০ বছরের কৃষিকাজের ইতিহাস ছড়িয়ে রয়েছে।’’

২০ ২১

শুধু কি সেটিই একমাত্র কারণ? বিশ্বের নানা প্রান্তে ভৌগোলিক-রাজনৈতিক উত্তেজনার আবহ থাকলেও ‘ডুমসডে ভল্টে’ তার চিহ্নমাত্র নেই। মানবজাতির স্বার্থে এখানে মিলেমিশে রয়েছে আমেরিকা, উত্তর কোরিয়া এবং চিনের শস্যদানা। সামরিক ক্ষেত্রে রাশিয়া এবং ইউক্রেন যুযুধান হলেও দু’দেশের থেকে আসা হিমায়িত বীজও একে অপরের বাক্সে শায়িত।

২১ ২১

লেইনফ বলেন, ‘‘একই সারিতে শুয়ে থাকা বীজগুলি পরোয়াই করে না সেগুলি কোরিয়ার উত্তর না দক্ষিণের। তারা ঠান্ডা ঘরে রয়েছে এবং সুরক্ষিত। এবং বাস্তবে সেটাই সবচেয়ে বড় কথা!’’

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement