২০২০ সালে সারা বিশ্বে থাবা বসিয়েছিল করোনাভাইরাস। অতিমারির গ্রাসে এক ধাক্কায় পৃথিবী থেকে মুছে গিয়েছে বহু প্রাণ। তছনছ হয়ে গিয়েছে স্বাভাবিক জনজীবন।
কোভিডের মোকাবিলা করতে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন রকম সতর্কতামূলক পদক্ষেপ করেছিল। দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাময়িক ভাবে বন্ধ করা হয়েছিল পরিবহণ ব্যবস্থা। তবে সে সবই এখন অতীত।
বর্তমানে করোনার কোপ থেকে মুক্ত বিশ্ব। ভাইরাস হয়তো নির্মূল হয়ে যায়নি। তবে সংক্রমিতের সংখ্যা কমে গিয়েছে। কমেছে করোনায় মৃত্যুর পরিমাণও। দেশে দেশে ছন্দে ফিরেছে স্বাভাবিক জীবন।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই করোনার বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছে। স্বাভাবিক করা হয়েছে যোগাযোগ এবং পরিবহণ ব্যবস্থা। কিন্তু একটি দেশ এখনও ২০২০ সালেই থমকে রয়েছে। তার নাম উত্তর কোরিয়া।
করোনা অতিমারির শুরুতে উত্তর কোরিয়ার দ্বার রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন একনায়ক কিম জং উন। চিন সীমান্তের লাগোয়া এই দেশটি সেই থেকে বাকি বিশ্বের থেকে বিচ্ছিন্ন। এখনও নিজের দেশকে রুদ্ধই করে রেখেছেন কিম।
করোনাভাইরাস যাতে বাণিজ্যিক পণ্যের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে না পারে, সেই কারণেই উত্তর কোরিয়ার সীমান্ত ‘সিল’ করে দিয়েছিলেন কিম। চিনের সঙ্গেও পণ্যের আদানপ্রদান তাতে বন্ধ হয়ে যায়।
উত্তর কোরিয়ার বাণিজ্যিক পণ্যের একটি বড় অংশই আসে চিন থেকে। খাদ্যশস্য এবং কৃষিকাজের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও চিন থেকে এই দেশটিতে আমদানি করা হয়। ২০২০ সালের পর থেকে যা বন্ধ রয়েছে।
সীমান্ত ‘সিল’ করে দেওয়ার পর থেকে দেশের অভ্যন্তরে কৃষিকাজের মাধ্যমে উৎপন্ন ফসল দিয়েই দিন কাটাচ্ছিল উত্তর কোরিয়া। কিন্তু তাতে বেশি দিন চলার কথা নয়। ফলে খাদ্যসঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে কিমের দেশ।
পরিস্থিতি এমনই যে, দেশে অনেকেই না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছেন। দিনের পর দিন খাবার জোটাতে না পেরে উপোস করে কাটাতে হচ্ছে বাসিন্দাদের। সবচেয়ে দুরবস্থা দেশের দরিদ্র এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির।
উত্তর কোরিয়ার জনসংখ্যা ২ কোটি ৬০ লক্ষ। অনেকেই বলছেন, একনায়কের খামখেয়ালি সিদ্ধান্তের জন্য দিন দিন দুর্ভিক্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। সেখানে স্থানীয়দের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন করা যাচ্ছে না।
উত্তর কোরিয়ার এক বাসিন্দা গোপনে বিবিসি-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তিনি তাঁর প্রতিবেশীদের বাড়িতে জল পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন। কেউ দরজা খোলেনি। পরে দেখা যায় জল এবং খাবারের অভাবে ওই পরিবারের তিন সদস্যই মারা গিয়েছেন।
চিন সীমান্ত লাগোয়া এলাকার এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, তিনি চোখের সামনে তাঁর গ্রামের পাঁচ জনকে না খেতে পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেছেন। তেষ্টার জলটুকুও জোগাড় করা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে উত্তর কোরিয়ায়।
রুদ্ধ সীমান্তে রয়েছে কিমের সেনার কড়া নজরদারি। সীমান্তের কাছাকাছি কেউ গেলে বা সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেই সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রক্ষীদের।
পরিস্থিতি এমনই যে, একসময় দেশের মানুষ কোভিডে মারা যাওয়ার ভয় পেতেন। এখন অভুক্ত অবস্থায় মৃত্যুর দিন গুনতে হচ্ছে তাঁদেরই। অভিযোগ, প্রশাসন দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাসে কর্ণপাত করছে না।
মানবাধিকার সংক্রান্ত বর্ষীয়ান গবেষক লিনা ইউন সিএনএন-কে জানিয়েছেন, অবিলম্বে উত্তর কোরিয়ার উচিত সীমান্ত উন্মুক্ত করে বাণিজ্য আবার চালু করা। দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থে খাদ্যের জোগান বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। তা বাণিজ্য বা বাইরে থেকে আমদানি ছাড়া সম্ভব নয়।
অনেকের মতে, উত্তর কোরিয়া এখনও কোভিডের আশঙ্কায় নিভৃতবাসকে প্রাধান্য দিচ্ছে। কিন্তু দেশের মানুষ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়লে নিভৃতবাসেও কোনও লাভ হবে না। অচিরেই নিজের বিপদ ডেকে আনছেন কিম।
কিমের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, তিনি দেশের মানুষের সাধারণ সমস্যাগুলিকে পাত্তা না দিয়ে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে ঝুঁকছেন। এক দিকে মানুষ খাবার জোটাতে পারছেন না। আর কিম লক্ষ লক্ষ টাকা পরমাণু অস্ত্রভান্ডারের জন্য খরচ করে চলেছেন।
দেশের হালচাল দেখে প্রমাদ গুনছেন উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতিবিদেরাও। তাঁরা জানাচ্ছেন, দরিদ্র এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির অবস্থা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। দেশে খাদ্যসঙ্কট দিন দিন মাথাচাড়া দিচ্ছে।
তবে এখনও দুর্ভিক্ষ বা সমাজব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ার কথা স্বীকার করতে চান না অর্থনীতিবিদেরা। দেশের পরিস্থিতি ভাল নয়, এ কথা মেনে নিয়েও তাঁরা আগামীর জন্য আশা রাখছেন।
নব্বইয়ের দশকে উত্তর কোরিয়া ভয়ানক দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয়েছিল। সে সময় ৩০ লক্ষের বেশি মানুষ স্রেফ না খেতে পেয়ে মারা গিয়েছিলেন। আগামী দিনে সেই পরিস্থিতি এড়াতে অবিলম্বে দেশকে ‘মুক্ত’ করা উচিত কিমের, মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।