স্কুলের গ্রুপ ডি নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় এসএসসির প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুবীরেশ ভট্টাচার্যের উপর চাপ বাড়ল। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশ, যত দিন না এই মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে, তত দিন নিজের ‘ডক্টরেট’ উপাধি ব্যবহার করতে পারবেন না সুবীরেশ।
এর আগে নিয়োগ দুর্নীতি মামলা চলাকালীন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ খুইয়েছিলেন সুবীরেশ। জেলে গিয়ে খুইয়েছেন সম্মানও। এ বার নিজের ‘ডক্টরেট’ উপাধিও খোয়ালেন। পাল্টা তাঁর উপর চাপ আরও বেড়েছে।
এই মামলার সূত্রেই বিচারপতি জানতে চান, কার নির্দেশে এত জনকে বেআইনি ভাবে নিযুক্ত করা হয়েছে? তাঁদের নাম প্রকাশ্যে আনার জন্য কমিশনের সুবীরেশকে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এই মামলায় সুবীরেশকে যুক্ত করারও নির্দেশ দিয়েছেন। মামলায় জেলবন্দি সুবীরেশকে যুক্ত করার জন্য কমিশনকে শুক্রবার পর্যন্ত সময় দিয়েছেন বিচারপতি। বিচারপতির নির্দেশ, আপাতত নিজের কোনও শিক্ষাগত যোগ্যতা ব্যবহার করতে পারবেন না সুবীরেশ। যদিও তাঁর পরিবারকে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিরাপত্তা দেবে বলে জানিয়েছেন বিচারপতি। কিন্তু কে এই সুবীরেশ? কী ভাবেই বা তিনি জড়িয়ে পড়লেন নিয়োগ দুর্নীতির জালে?
শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির মামলায় গত ১৯ সেপ্টেম্বর এসএসসির প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য সুবীরেশকে নিজাম প্যালেসে তলব করে গ্রেফতার করেছিল সিবিআই। তার আগেও তাঁকে তলব করেছিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা।
একের পর এক অভিযোগ এবং মামলার পর গত বছরের গোড়া থেকে ধীরে ধীরে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়েও জট পাকাতে শুরু করে। এসএসসির গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি থেকে প্রাথমিক— সব নিয়োগেই একের পর দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। নাম উঠে আসতে শুরু করে একের পর এক ‘প্রভাবশালী’র।
রাজ্যের অপসারিত শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্রোপাধ্যায় ‘ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের দু’টি ফ্ল্যাট থেকে নগদ প্রায় ৫০ কোটি এবং একাধিক নথি উদ্ধারের পর নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হন পার্থও।
এর পর ধীরে ধীরে সেই মামলায় উঠে আসে সুবীরেশের নাম। তদন্তকারী আধিকারিকদের ‘চাপে’ গত বছরের ২৫ অগস্ট বাগডোগরা বিমানবন্দর থেকে কলকাতা উড়ে আসেন সুবীরেশ।
কলকাতা বিমানবন্দর থেকে আত্মীয়ের বাড়িতে চলে আসেন সুবীরেশ। সেখান থেকে চলে যান নিজের বাঁশদ্রোণীর ফ্ল্যাটে। তখন সিবিআইয়ের তরফে তাঁর ফ্ল্যাট সিল করা হয়েছিল। অগত্যা সস্ত্রীক বাড়ির ছাদে উঠে যান সুবীরেশ।
বাড়ির ছাদ থেকেই সাংবাদিকদের হুঙ্কার করে জানিয়েছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’। এ-ও দাবি করেন, তাঁর আমলে এসএসসি নিয়োগে পদ্ধতিগত কিছু ত্রুটি থাকলেও কোনও দুর্নীতি হয়নি।
এসএসসি দুর্নীতি তদন্তে তৈরি হওয়া বাগ কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছিল, সেই রিপোর্টেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনও দুর্নীতির অভিযোগ নেই বলে দাবি করেন সুবীরেশ। যদিও এসএসসি-র উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিন্হার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে কোনও মন্তব্য করতে সেই সময় চাননি সুবীরেশ।
তার পর থেকে আরও কয়েক দিন সিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হন সুবীরেশ। এর পর ১৯ সেপ্টেম্বর সুবীরেশকে নিজাম প্যালেসে তলব করে গ্রেফতার করে সিবিআই। কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার আধিকারিকদের অভিযোগ ছিল, বড় ষড়যন্ত্রে যুক্ত সুবীরেশ।
তদন্তকারী সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে, সুবীরেশ এসএসসির চেয়ারম্যান থাকাকালীন তাঁর নির্দেশেই কিছু নির্দিষ্ট পরীক্ষার্থীর মার্কশিটের নম্বর বদল করা হয়েছিল। নিয়োগ দুর্নীতি মামলার তদন্তে সিবিআইকে সহযোগিতা না করার অভিযোগও আনা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। যদিও এর মধ্যে কোনও অভিযোগই স্বীকার করেননি সুবীরেশ।
পার্থ এবং সুবীরেশের পাশাপাশি এসএসসি মামলায় অভিযুক্ত আরও ৫ জন— এসএসসি-র প্রাক্তন উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিংহ, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়, এসএসসির প্রাক্তন চেয়ারম্যান অশোক সাহা এবং দুই ‘মিডলম্যান’ প্রসন্ন ও প্রদীপকে গ্রেফতার করা হয়।
তার পর থেকে তাঁরা সবাই জেল হেফাজতেই রয়েছেন। এর মধ্যেই নিজের উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ খোয়ান সুবীরেশ। একের পর এক শুনানিতেও জামিন পাননি তিনি।
এর মধ্যেই সুবীরেশের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ উঠে আসে। সুবীরেশ জমানায় অযোগ্য প্রার্থীরা সাদা খাতা জমা দিয়েও নিয়োগ পেয়েছেন বলে সিবিআইয়ের তরফে অভিযোগ আনা হয়। এ-ও অভিযোগ ওঠে, সুবীরেশের কথাতেই নাকি ৬৬৭ জন অযোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে সুবীরেশের নির্দেশেই ওই অযোগ্য প্রার্থীদের ওএমআর শিট বদলে ফেলা হয় বলেও দাবি করে সিবিআই।
চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি সুবীরেশের বিরুদ্ধে সরব হন পশ্চিমবঙ্গ অধ্যক্ষ পরিষদ (অল বেঙ্গল প্রিন্সিপাল কাউন্সিল)-এর সদস্যরাও। তাঁদের অভিযোগ, গ্রেফতার হওয়ার পরও সুবীরেশ বহাল থেকে গিয়েছেন অধ্যক্ষ পরিষদের প্রেসিডেন্ট পদে।
সুবীরেশের পদে থাকা নিয়ে ওই অধ্যক্ষদের দাবি ছিল, জোর করে এবং বেআইনি ভাবে অধ্যক্ষ পরিষদের প্রেসিডেন্টের পদ ধরে রেখেছেন সুবীরেশ। তাঁরা জানিয়েছেন, সুবীরেশ শ্যামাপ্রসাদ কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন অধ্যক্ষ পরিষদের প্রেসিডেন্ট হন। নিয়ম অনুযায়ী, দু’বছর অন্তর প্রেসিডেন্ট পদে নতুন কারও বসার কথা। কিন্তু ২০১৭ সালের পর থেকে ছ’বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও ওই পদ ছাড়েননি সুবীরেশ।
অধ্যক্ষদের দাবি ছিল, ২০১৯-এ প্রেসিডেন্ট বদলের কথা উঠলেও লোকসভা নির্বাচনের জন্য তা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে পুরো প্রক্রিয়া পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরের বছর আবার করোনা অতিমারির কারণে প্রেসিডেন্ট বদলের প্রক্রিয়া পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার পরেও সুবীরেশ অধ্যক্ষ পরিষদের প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়েননি বলে অভিযোগ ওঠে।
এর পর পরই কোচবিহার কলেজে পশ্চিমবঙ্গ অধ্যক্ষ পরিষদের রাজ্য সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক তথা সিধো কানহো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দীপক কর জানান, সংগঠনের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই সুবীরেশের। সংগঠনের নতুন কমিটি তৈরির ঘোষণাও তিনি করেন।
সব হারানো সেই সুবীরেশ এ বার নিজের ‘ডক্টরেট’ উপাধিও সাময়িক ভাবে হারালেন। পাশাপাশি শুক্রবারের শুনানির সময় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে চাকরি বাতিল হল হাই স্কুলের ১,৯১১ গ্রুপ ডি কর্মীর।
অনেক দিন শুনানি চলার পর শুক্রবার স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)-এর আইনজীবী আদালতে স্বীকার করে নিলেন, ১,৯১১ জন গ্ৰুপ-ডি প্রার্থীকে অন্যায় ভাবে নিয়োগ করা হয়েছিল।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় জানতে চান, সেই সময় এসএসসি-র চেয়ারম্যান কে ছিলেন। এসএসসি-র আইনজীবী জানান, সুবীরেশ ভট্টাচার্য। কমিশন তথ্য যাচাই করে আদালতে হলফনামা দিয়ে স্বীকার করে, ওই সব প্রার্থীর উত্তরপত্র (ওএমআর শিট)-এ কারচুপি করে চাকরির সুপারিশপত্র দেওয়া হয়েছিল। তার পরই সুবীরেশকে ওই নির্দেশ কলকাতা হাই কোর্টের।