২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বরের রাত। সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন তাঁর পুরুষ বন্ধুও। দিল্লির রাজপথে ওই তরুণীকে নৃশংস ভাবে নির্যাতন করা হয়। যার বিশদ বিবরণের কথা মনে করলে আজও শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নামে।
২৩ বছরের ফিজিয়োথেরাপির ছাত্রী, যাঁকে এর পর দেশ নির্ভয়া বলে জানবে, সে দিন তাঁর বন্ধুর সঙ্গে দিল্লির একটি বাসে উঠে বসেছিলেন বাড়ি ফিরবেন বলে। তার পরই ঘটে সেই ঘটনা।
বাসে সেই সময় ছিলেন ছ’জন। এই ছ’জন প্রথমে ওই ছাত্রীর বন্ধুকে মেরে অজ্ঞান করে দেয়। তার পর তরুণীকে বাসের পিছনে টেনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে এবং লোহার রড অমানবিক ভাবে অত্যাচার করে ২৩ বছরের ওই ছাত্রীর উপর। বাসটি অবশ্য থামেনি। বরং ভিতরে যখন এই চরম নির্যাতন চলছে, তখন বাসটি চলছিল শহরেরই রাস্তায় রাস্তায়।
প্রায় এক ঘণ্টা পর দু’জনেরই মৃত্যু হয়েছে ভেবে তাঁদের চলন্ত বাস থেকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয় দিল্লির রাস্তায়।
১৭ ডিসেম্বর ঘটনাটি জানাজানি হতেই আতঙ্কে কেঁপে ওঠে গোটা দেশ। নির্ভয়াকে উদ্ধার করে ভর্তি করা হয় দিল্লির হাসপাতালে। হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁর বন্ধুকেও। চিকিৎসকেরা মেডিক্যাল পরীক্ষা করে জানান, নির্ভয়ার শরীরে ভিতরের বিভিন্ন অন্ত্র লোহার রডের খোঁচায় জখম হয়েছে, অমানবিক অত্যাচার করা হয়েছে তাঁর উপর।
চিকিৎসকদের বক্তব্য প্রকাশ্যে আসতেই আতঙ্কে কেঁপে ওঠে দেশের মানুষ। শুরু হয় ধর্ষণকারীদের খোঁজ।
১৮ ডিসেম্বর সেই বাসের চালক রাম সিংহ, তাঁর ভাই মুকেশ, এবং বাসে থাকা অন্য দু’জন বিনয় শর্মা এবং পবন গুপ্তকে গ্রেফতার করা হয়।
২১ ডিসেম্বর একটি বাস টার্মিনাসে ধরা পড়ে এই ঘটনার একমাত্র নাবালক আসামি।
২২ ডিসেম্বর বিহার থেকে ষষ্ঠ অভিযুক্ত অক্ষয় ঠাকুরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর পরই দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে নির্ভয়ার বয়ান রেকর্ড করা হয়। শারীরিক ভাবে তখনও আশঙ্কাজনক নির্ভয়া। এর মধ্যেই চিহ্নিত করেন নির্যাতনকারীদের।
তবু বাঁচার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন নির্ভয়া। কিন্তু ৫ দিন পর অবস্থার আরও অবনতি হয়। ২৭ ডিসেম্বর উন্নততর চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় ২৩ বছরের তরুণীকে।
২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঠিক ১৩ দিনের মাথায় মৃত্যু হয় তাঁর। গোটা দেশ ফেটে পড়ে প্রতিবাদে। অপরাধীদের অবিলম্বে মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে দেশের প্রায় প্রতিটি শহরের রাস্তায় নামে মিছিল।
২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি মামলাটির দ্রুত বিচারের জন্য দেশে প্রথম দ্রুত নিষ্পত্তি আদালত বা ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট গঠন করা হয় দিল্লিতে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই নির্ভয়ার গণধর্ষণ ও খুনের মামলায় চার্জশিট পেশ করে পুলিশ।
কিন্তু মামলাটির শুনানি শুরু হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই তিহাড় জেলে আত্মহত্যা করে ওই বাসের চালক রাম। ১১ মার্চ জেলের সেলেই ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় রামের দেহ।
৩১ অগস্ট, রামের অস্বাভাবিক মৃত্যুর সাড়ে ৫ মাস পর নির্ভয়ার নাবালক নির্যাতনকারী জুভেনাইল বোর্ডে ধর্ষণ ও খুনে দোষী সাব্যস্ত হয়। তাকে তিন বছর হোমে রাখার নির্দেশ দেয় জুভেনাইল বোর্ড।
ওই বছরই ১৩ সেপ্টেম্বর নির্ভয়ার উপর অত্যাচারকারী বাকি চার জনের ফাঁসির আদেশ দেয় দিল্লির নিম্ন আদালত।
ঠিক ছ’মাস পর ২০১৪ সালের ১৩ মার্চ নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখে দিল্লি হাই কোর্টও।
২০১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর, নির্ভয়া কাণ্ডের ঠিক তিন বছর পেরোতেই নাবালক নির্যাতনকারী মুক্তি পায়। যা নিয়ে আবার বিক্ষোভ শুরু হয় দেশে।
এই নাবালক অপরাধীই নির্ভয়ার উপর অত্যাচারকারীদের মধ্যে ঘৃণ্যতম বলে অভিযোগ। তার মুক্তিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেন নির্ভয়ার পরিবারও। কিন্তু জুভেনাইল জাস্টিস আইন অনুযায়ী অপরাধীর বয়স ১৮ বছরের কম হলে তাকে এর বেশি শাস্তি দেওয়া সম্ভব নয়।
কিন্তু এ নিয়ে দেশ জুড়ে বিক্ষোভ প্রতিবাদের জেরে শেষে কেন্দ্র বাধ্য হয় জুভেনাইল জাস্টিস আইনে বদল আনতে। ঠিক হয়, ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সি নাবালক যদি মারাত্মক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়, তবে তাকে নাবালক হিসাবে দেখবে না বিচার ব্যবস্থা।
বাকিদের ফাঁসির সাজা বহাল থাকে। ২০১৭ সালের ৫ মে ওই সাজা বহাল রাখার রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট।
অভিযুক্তদের মধ্যে অক্ষয় ঠাকুর প্রাণদণ্ড পুনর্বিবেচনার আর্জি জানান সুপ্রিম কোর্টে। ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর সেই আর্জি খারিজ করে দেয় দেশের শীর্ষ আদালত।
২০২০ সালের ৭ জানুয়ারি পটীয়ালা হাউস কোর্ট রায় দেয়, নির্ভয়ার চার অপরাধীকেই ফাঁসিতে ঝোলানো হবে ২২ জানুয়ারি।
২০২০ সালের ১৭ জানুয়ারি বিনয় এবং মুকেশের রায় সংশোধনের আর্জিও খারিজ হয়ে যায় সুপ্রিম কোর্টে।
এর পর দু’দফায় দু’বার পিছিয়ে যায় ফাঁসির দিন। নতুন নতুন আর্জির জেরে ফাঁসির জন্য প্রথমে ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, তার পর ২ মার্চ শেষে নির্ধারিত দিন পিছিয়ে হয় ২০ মার্চ।
২০ মার্চ সুবিচার পান নির্ভয়া। ৮ বছর পর বিচারের বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়। ফাঁসি হয় নির্ভয়ার চার অপরাধীর।
তার পরও দু’বছর কেটে গিয়েছে। নির্ভয়ার ঘটনার ১০ বছর পরও কি কিছু বদলেছে? নির্ভয়ার মা বলছেন, ‘‘কিচ্ছু বদলায়নি। বিচার শুধু নির্ভয়াই পেয়েছে। বাকিরা নয়। তা না হলে এই দু’দিন আগেও এক ১৭ বছরের স্কুলছাত্রীকে রাস্তায় অ্যাসিড ছুড়ে মারা হয়! কী দোষ ছিল মেয়েটির?’’ সত্যিই! কী দোষ থাকে নির্ভয়াদের?