কোটি কোটি ডলারের মালকিন হলেও রাতবিরেতে নিজের ভাঙাচোরা গাড়িতে চেপে জঞ্জাল কুড়িয়ে বেড়ান। সেগুলি বিক্রি করে রোজগারও করেন নিউ ইয়র্কের এক বৃদ্ধা। ধনকুবের হওয়া সত্ত্বেও এমনটা করেন কেন? বৃদ্ধার পড়শিরা বলেন, এ সবই নাকি তাঁর খামখেয়ালিপনা।
নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের মতো অভিজাত মহল্লায় একটি প্রাসাদ রয়েছে ওই খামখেয়ালি বৃদ্ধার। তবে সেটির অবস্থা বেশ সঙ্গিন। প্রাসাদের দেওয়াল ভেঙে পড়ার জোগাড়। মেঝের অনেকটা অংশ ধসে পড়েছে। মরচেধরা কার্নিশের নীচে বহু জানলার পাল্লা গায়েব। ছাদে বড়সড় গর্ত। ভিতরে রেকুনের আনাগোনা।
ম্যানহাটনের বাসিন্দা ৭১ বছরের লিজা ফিকস্কির ওই ফাঁকা প্রাসাদে হামেশাই ঢুকে পড়েন ভবঘুরেরা। মাদকসেবীদের পছন্দের আড্ডাখানাও হয়ে উঠেছে সেটি। নিউ ইয়র্ক শহর কর্তৃপক্ষের মোটা জরিমানা সত্ত্বেও প্রাসাদের সংস্কার করতে নাকি রাজি নন লিজা।
লিজার ওই প্রাসাদটি প্রায় ১২৫ বছরের পুরনো। শহরে ঐতিহ্যবাহী ভবনের তালিকায়ও সেটির ঠাঁই হয়েছে। তবে বেহাল দশার জন্য সেটিকে ‘বিপজ্জনক’ তকমা দিয়েছেন শহর কর্তৃপক্ষ। তাঁদের মতে, ‘‘শহরবাসী, তথা ওই বিল্ডিংয়ের আশপাশের বাসিন্দাদের সুরক্ষার পক্ষে প্রাসাদটি বিপজ্জনক।’’
দীর্ঘ দিন ধরে প্রাসাদের সংস্কার না করানোর জন্য লিজার বিরুদ্ধে বহু বার অভিযোগ উঠেছে। গত মাসেও আদালতে নালিশ ঠুকেছেন শহর কর্তৃপক্ষ। কারণ নিউ ইয়র্কের আইন অনুযায়ী, শহরের ঐতিহ্যবাহী বিল্ডিংগুলির সংস্কার জরুরি। তবে সে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই বছরের পর বছর ধরে প্রাসাদের কোনও সংস্কার করাননি লিজা। তাঁর দাবি, প্রাসাদে ঢোকার রাস্তার অপ্রতুলতা এবং রেকুনের জ্বালায় বার বার এর সংস্কারে বাধা এসেছে।
ম্যানহাটনের হার্লেমের ৪৫১ কনভেন্ট অ্যাভিনিউয়ের ওই প্রাসাদের বিরুদ্ধে গত ন’বছরে হাজারো জরিমানার নোটিস জমা পড়েছে। এমনকি, প্রাসাদের সংস্কার না করানোর অভিযোগে একটি মামলাও রুজু করা হয়েছে লিজার বিরুদ্ধে। তবে তাতেও নাকি লিজার হেলদোল নেই।
২০১৩ সালে রেনেসাঁ রিভাইভাল আঙ্গিকে তৈরি হার্লেমের এই প্রাসাদটি কিনেছিলেন লিজা। যদিও তিনি নিজে থাকেন ব্রুকলিনে। সুগার হিল ডিসট্রিক্টের এই চোখধাঁধানো প্রাসাদটিকে ২০০১ সালে ঐতিহ্যবাহী বিল্ডিংয়ের তকমা দেন জেলা কর্তৃপক্ষ।
১৮৯৭ সালের ওই প্রাসাদ চত্বরে গায়ে গায়ে লাগানো চারটি বিল্ডিংয়ের সারি রয়েছে। বহু বছর আগে তার একটিতে আগুন লেগে প্রাসাদের দশা আরও বেহাল হয়েছে। তবে এর দেওয়ালজোড়া কারুকাজ বা চুনাপাথরে সাজানো প্রাসাদটি এখনও নজরকাড়া।
প্রাসাদটির সংস্কার নিয়ে ২০১৯ সালে লিজার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছিল নিউ ইয়র্কের ল্যান্ডমার্ক প্রিজারর্ভেশন কমিশন। সেই সঙ্গে তারা হুমকিও দিয়েছিল যে, সংস্কার না করালে তাঁকে প্রতি দিন ৫,০০০ ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৪ লক্ষ টাকা) করে জরিমানা দিতে হবে।
ওই মামলায় আদালতের রায় লিজার বিপক্ষে গেলেও প্রাসাদটির সংস্কার করতে তাঁকে বাধ্য করেননি বিচারক। তবে বছর দুই পরে নিউ ইয়র্কের ডিপার্টমেন্ট অব বিল্ডিংস (ডিওবি) কর্তৃপক্ষ ওই মামলার রায় নিয়ে আবারও নড়েচড়ে বসেছেন। এ বার তাঁরা বদ্ধপরিকর— সংস্কার না করালে প্রাসাদটি ভেঙে ফেলা হবে। এবং তার প্রস্তুতি হিসাবে চলতি মাসে প্রাসাদের নিকাশি এবং জলের লাইনও কেটে দিয়েছে ডিওবি।
নিজেদের মহল্লায় এমন একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাসাদ ভাঙার খবর পেয়ে অনেকেই ভেঙে পড়েছেন। অনেকে আবার দাবি করেছেন, আসলে ওই প্রাসাদের থেকে তার জমির দিকে নজর রয়েছে লিজার। প্রাসাদটি ভাঙা পড়লে ওই জমি বিক্রি করে আরও কয়েক লক্ষ ডলার কামানোর জন্যই নাকি সেটির সংস্কারে লিজার এত অনীহা!
প্রাসাদটির পাশেই বসবাস করেন মেট্রোপলিটন ট্রান্সপোর্টেশন অথরিটির ডিরেক্টর প্রোজ্জ্বল দত্ত। লিজাকে কটাক্ষ করে তাঁর দাবি, ‘‘এই প্রাসাদটি ভাঙা হলে শহরের একটি মূল্যবান অভিজ্ঞান চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে। তবে এক জন ধনকুবের আরও কয়েক লাখ ডলার আয় করবেন।’’
প্রোজ্জ্বলের আরও দাবি, ‘‘এই বিল্ডিংটা ভাঙা পড়ুক, এমনই তো চান লিজা। কারণ আমার মনে হয় যে এর জমির দাম ওঁর কাছে আরও লোভনীয় সওদা। রূঢ় শোনালেও এটাই মনে হয় আমার।’’
প্রাসাদটির সংস্কারে লিজার কেন এত ‘অনীহা’, তা নিয়েও ধন্দে পড়েছেন এলাকার বাসিন্দারা। এক কালে এটি অ্যান্ড টি-র মতো বহুজাতিক সংস্থার মার্কেট অ্যানালিস্ট বা শেয়ারবাজারের স্টকব্রোকার হিসাবে কাজ করা লিজার নাকি এ সবই খামখেয়ালিপনা।
নামীদামি সংস্থার কাজ করা লিজার ঝুলিতে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ডিগ্রি রয়েছে। তাঁর বাবা ছিলেন ওয়াশিংটনের এক নামজাদা অর্থনীতিবিদ। ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের প্রধান হিসাবে কাজ করতেন তিনি। লেবার ডিপার্টমেন্টের আধিকারিক হিসাবে মা গোটা বিশ্ব চষে বেড়াতেন।
বিত্তশালী পবিবারে মানুষ হলেও ব্রুকলিনের প্রসপেক্ট পার্কে একটি সমবায় সোসাইটিতে বাস করেন লিজা। যিনি গ্রাফিতি আঁকা একটি টয়োটা ক্যাম্রি চড়ে ম্যানহাটন এবং ব্রুকলিন এলাকার জঞ্জাল কুড়িয়ে বেড়ান।
সুগার হিল ডিসট্রিক্টে ওই ভাঙাচোরা প্রাসাদ ছাড়াও হার্লেমে আরও দু’টি ঐতিহ্যবাহী বিল্ডিংয়ের মালকিন লিজা। তবে সেগুলিও ফাঁকা পড়ে রয়েছে। সেগুলিও দশা কম বেহাল নয়। পড়শিরা জানিয়েছেন, বছরের পর বছর ধরে ওই বিল্ডিংগুলির ভিতরে জমা হওয়া আবর্জনার দুর্গন্ধে এলাকায় টেকা দায় হয়ে পড়েছে।
বেহাল দশা হলেও হার্লেমের ওই দু’টি বিল্ডিংয়ের বাজারদর ৪০ লক্ষ ডলারে গিয়েছে ঠেকেছে বলে জানিয়েছেন শহর কর্তৃপক্ষ।
এত বছরে এক বারও কি প্রাসাদ সংস্কার করাতে উদ্যোগী হননি লিজা? শহর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, বেশ কয়েক বার সংস্কার করার অনুমতি পেলেও শেষ মুহূর্তে তা বাতিল করে দিয়েছেন লিজা।
২০১৮ সালে আমেরিকার একটি সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে লিজা জানিয়েছিলেন, ভাঙাচোরা প্রাসাদটি সংস্কার করার পরিকল্পনা করছেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘‘নিউ ইয়র্কে থাকতে গেলে সব সময়ই কিছু না কিছু সংস্কার করাতে হবে আপনাকে। কারণ শহরের লোকজন আপনাকে দিয়ে তা-ই করাতে চান।’’ তবে এর বছরখানেক পরেই সংস্কারের পরিকল্পনা বাতিল করে দেন। সে সময় লিজা বলেছিলেন, প্রাসাদ সংস্কারের সময় নেই তাঁর হাতে। তিনি ব্যস্ত!