নিয়ান্ডারথালদের যৌনজীবন নিয়ে নতুন দাবি করলেন গবেষকেরা। তাঁদের দাবি, গুহার ভিতরে থেকে নিজেদের ঘনিষ্ঠদের সঙ্গেই বার বার যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হতেন সে সময়ের প্রাচীন পুরুষেরা।
তবে যৌনসঙ্গীর খোঁজে গুহার নিরাপত্তা ছেড়ে বাইরে বেরোতেন মহিলারা। বাইরের জগৎ থেকে অন্য নিয়ান্ডারথালদের মধ্যে থেকে যৌনসঙ্গী বেছে নিতেন তাঁরা।
১৯ অক্টোবর ‘নেচার’ পত্রিকায় এই আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে। তাতে নিয়ান্ডারথালদের যৌনজীবন নিয়ে নতুন তথ্য দিয়েছেন গবেষকরা।
গবেষণাপত্র অনুযায়ী, রাশিয়ার দক্ষিণ সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে উদ্ধার ১৩টি নিয়ান্ডারথালের ডিএনএ সিকোয়েন্স করে নানা নতুন তথ্য পাওয়া গিয়েছে। ওই যুগের গুহামানবদের যৌনজীবন ছাড়াও তাঁদের সামাজিক জীবন নিয়েও নতুন ধারণার জন্ম দিয়েছেন গবেষকরা।
প্রসঙ্গত, ঠিক কত বছর আগে নিয়ান্ডারথালরা পৃথিবীর বুকে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, তা নিয়ে আজও ধোঁয়াশা রয়েছে। যদিও সবচেয়ে পুরনো যে নিয়ান্ডারথালের সময়কার অনুরূপ দেহাবশেষ উদ্ধার হয়েছে, তা খ্রিস্টপূর্ব ৪ লক্ষ ৩০ হাজার বছর আগেকার। তা সত্ত্বেও যুগবিভাগ নিয়ে স্পষ্ট ধারণা করা যায়নি।
অন্য দিকে, অসংখ্য মানবজীবাশ্ম থেকে নিয়ান্ডারথালদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা গিয়েছে। সেগুলির অনেকগুলি খ্রিস্টপূর্ব ১ লক্ষ ৩০ হাজার বছর আগেকার। অনেকের দাবি, খ্রিস্টপূর্ব ১ লক্ষ ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার বছরের মধ্যে নিয়ান্ডারথালদের অস্তিত্ব ছিল। তার পরের সময় থেকে তাঁদের অস্তিত্ব সংক্রান্ত কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না বলে দাবি।
নতুন গবেষণাপত্রে দাবি, নিজেদের গুহার কাছাকাছি থাকলেও আত্মীয়দের সঙ্গে যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হওয়ার প্রবণতা ছিল না নিয়ান্ডারথালদের উপপ্রজাতির। এমনকি, ডেনিসোভানস নামে এক উপপ্রজাতির সদস্যরা কয়েকশো কিলোমিটার দূরে বসবাস করলেও তাঁদের মধ্যে যৌনসঙ্গী খুঁজতেন না।
যদিও নিয়ান্ডারথালদের উপপ্রজাতি যে এককালে হোমোসেপিয়েনস-এর সঙ্গে যৌনতায় মেতেছিলেন, সে দাবিও করেছেন ওই গবেষণাপত্রটি।
ওই গবেষণাপত্রটির আরও দাবি, আধুনিক যুগের প্রায় সমস্ত মানবদেহের জীবাশ্মে নিয়ান্ডারথালদের কিছু ডিএনএ পাওয়া গিয়েছে।
নিয়ান্ডারথালদের মধ্যে যে বিশেষ জিনবৈচিত্র মেলেনি, গবেষণাপত্রে তা-ও জানিয়েছেন বিবর্তন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের দাবি, নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যেই বংশবৃদ্ধি করতে পছন্দ করতেন নিয়ান্ডারথালরা।
এই প্রবণতার কারণও ব্যাখ্যা করেছেন গবেষকরা। তাঁদের মতে, নিয়ান্ডারথালরা নিভৃতবাসে থাকতেন বলে তাঁদের এ ধরনের প্রবণতা ছিল বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে ধরাছোঁয়ার বৃত্তে হয়তো যৌনসঙ্গীর খোঁজ করতেন না তাঁরা।
এই নতুন দাবি নিয়ে সংবাদ সংস্থা এএফপি-কে নিজেদের মতামত দিয়েছেন গবেষণার সঙ্গে জড়িত বিবর্তন বিশেষজ্ঞরা। গবেষণাপত্রটির সহ-লেখক তথা জার্মানির ‘ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট অফ হিউম্যান হিস্ট্রি’র ইভোলিউশনারি জেনেসিস্ট স্টেফান পেরেঞ্জ বলেন, ‘‘আমরা হয়তো একটি অতিমাত্রায় উপবিভক্ত জনসংখ্যার যৌনজীবন নিয়ে গবেষণাপত্রে আলোচনা করেছি।’’
ওই উপপ্রজাতির ক্রোমোজ়োমগুলি বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকরা। তাতে দেখা গিয়েছে, উত্তরাধিকার সূত্রে বাবার থেকে যে ওয়াই ক্রোমোজ়োম পাওয়া গিয়েছে, তা যথেষ্ট বৈচিত্রপূর্ণ। যদিও মায়ের তরফে পাওয়া মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ-তে বিশেষ বৈচিত্র নেই। এর অর্থ কী?
গবেষকদের দাবি, অন্য গোষ্ঠীর নিয়ান্ডারথালদের মধ্যে যৌনসঙ্গী খুঁজতে মহিলারা গুহার ঘন ঘন বেরিয়েছেন। তবে যৌনচাহিদা মেটাতে পুরুষেরা নিজেদের আশ্রয়স্থল অর্থাৎ গুহা ছেড়ে নড়েননি।
স্বাভাবিক ভাবেই এই গবেষণাপত্রটি নিয়ে বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে আলোচনাও শুরু হয়েছে। ফ্রান্সের ‘ন্যাচারাল মিউজ়িয়াম অফ হিস্ট্রি’-র জীবাশ্মবিদ আতোয়াঁ বালজ়ো সংবাদমাধ্যমে বলেন, ‘‘গবেষণাটি যে খুবই আকর্ষণীয়, তাতে সন্দেহ নেই।’’ যদিও তাঁর মতে, অন্যান্য গবেষণার সঙ্গে এর তুলনা টেনে তার পর নিয়ান্ডারথালদের নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত করা উচিত।
তবে বালজ়োর সঙ্গে সহমত নন এই গবেষণাপত্রের সহ-তত্ত্বাবধায়ক বেঞ্জামিন পিটার। একটি বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘‘নিয়ান্ডারথালদের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে আমাদের গবেষণাপত্রটি।’’ বস্তুত, আগে মনে করা হত যে হোমোসেপিয়েন্সের থেকে বিশেষ বুদ্ধিসম্পন্ন নন নিয়ান্ডারথালরা। তবে বেঞ্জামিনের মন্তব্য, ‘‘নিয়ান্ডারথালরা যে আমাদের মতোই মানুষ, তা মনে হচ্ছে আমার।’’