‘মহাভারত’-এর কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ ছিল ১৮ দিনের। এই ১৮টি দিনের যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বেদব্যাস লিখে গিয়েছেন, তা আধুনিক যুদ্ধকেও হার মানায়। অগণিত লোকক্ষয়, বিপুল সম্পদের বিনাশ ইত্যাদির পাশাপাশি যে বিষয়টি পাঠকের নজর কাড়ে, সেটি এই যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র। বিচিত্র এই সব অস্ত্রের বর্ণনা থেকে অনেকেরই অনুমান, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল পারমাণবিক অস্ত্র অথবা তার তুল্য কিছু আয়ুধ।
রাজস্থানের জোধপুরের কাছে এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তেজস্ক্রীয় বিকিরণের সন্ধান পান প্রত্নতত্ত্ববিদরা। পরে জানা যায়, সেই অঞ্চল হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইংরেজ প্রত্নবিদ ডেভিড ড্যাভেনপোর্ট সেই অঞ্চলে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে এমন কিছু প্রমাণ পান, যা থেকে অনুমান করা যায় সেখানে সুদূর অতীতে কোনও বিপুল বিস্ফোরণ ঘটেছিল। এই বিস্ফোরণকে ড্যাভেনপোর্ট পারমাণবিক শক্তি থেকেই জাত বলে মনে করেন। সেই সব কথা তিনি তাঁর বই ‘অ্যাটমিক ডেস্ট্রাকশন ইন ২০০০ বিসি’ (১৯৭৯)-তে লিখেছেন।
ড্যাভেনপোর্ট ১২ বছর ধরে প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন এবং মহেঞ্জোদারো অঞ্চলে অনুসন্ধান চালান। মহেঞ্জোদারো নগরীর ধ্বংসের পিছনে তিনি পারমাণবিক বিপর্যয়কেই দায়ী করেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, সেই যুগে কে বা কারা ব্যবহার করেছিল এমন শক্তিকে? মহেঞ্জোদারোয় গলে যাওয়া ইট এবং সবুজ রঙের স্ফটিকায়িত এক বস্তু থেকেই এই সিদ্ধান্তে আসেন ড্যাভেনপোর্ট। তাঁর দাবি ‘মহাভারত’-এর মধ্যেই এই শক্তি ব্যবহারের বর্ণনা রয়েছে।
সন্দেহবাতিক পণ্ডিতদের অনেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন আমেরিকার পারমাণবিক গবেষণা-প্রকল্প ম্যানহাটন প্রজেক্ট নিয়ে এমন কিছু প্রশ্ন তোলেন, যা রীতিমতো কৌতূহল উদ্রেককারী। এই প্রকল্পের অন্যতম রূপকার রবার্ট ওপেনহেইমার (যিনি পরমাণু বোমার অন্যতম জনক হিসেবেও স্বীকৃত) নাকি ১৯৩৩ সাল থেকে নিবিষ্ট ছিলেন সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের চর্চায় এবং তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ‘ভাগবদ্গীতা’ সংস্কৃতে পাঠ করা।
ম্যানহাটন প্রজেক্ট শেষ হলে ওপেনহেইমারকে এক ছাত্র প্রশ্ন করেন, তাঁর তৈরি পারমাণবিক বোমাই কি বিশ্বের প্রথম পরমাণু-অস্ত্র। ওপেনহেইমার বলেছিলেন, “আধুনিক যুগের নিরিখে কথাটি ঠিক...।” তা হলে কি ধরে নিতে হবে সংস্কৃতজ্ঞ পরমাণু-বিজ্ঞানী পুরাকালে পারমাণবিক অস্ত্রের অস্তিত্বের কোনও খোঁজ পেয়েছিলেন?
‘শ্রীমদ্ভভাগবদ্গীতা’-র একাদশ অধ্যায়ের দ্বাদশ শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন- ‘দিবি সূর্যসহস্রায় ভবেদ যুগপদুত্থিতা।/যদি ভাঃ সদ্রশী সা স্যাৎভাস্বতস্য মহাত্মনঃ।।’ যার অর্থ— ‘যদি আকাশে সহস্র সূর্যের সমান বিকিরণ দেখা যায়, তবে তাকে মহাশক্তিমানের প্রকাশ হিসেবে ধরতে হবে’। এই শ্লোকের উচ্চারণে বিমূঢ় অর্জুন কৃষ্ণকে প্রশ্ন করেন— ‘কে আপনি?’ উত্তরে কৃষ্ণ জানান, তিনিই মৃত্যু, জগৎসমূহের সংহারকর্তা। পরবর্তী কালে সন্ধানীরা প্রশ্ন তোলেন, এই ‘সহস্র সূর্যের সমান বিকিরণ’ কি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ? কী করে তা কল্পিত হল মহাভারতীয় যুগে?
মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ অবশ্যই সিন্ধু সভ্যতার কালে ঘটেনি। কিন্তু সেই সভ্যতা থেকে বয়ে আসা প্রযুক্তিগত জ্ঞান যে কুরুবংশের আমলেও সজীব ছিল না, তা কে বলতে পারে?
অষ্টাদশ পর্ব ‘মহাভারত’-এর কথাই সর্বজনবিদিত। কিন্তু ২০১৩ সালে ক্রিস্টোফার সি ডয়েল নামের এক ভারতীয় লেখক এই মহাকাব্যে আরও একটি পর্ব ছিল বলে দাবি করে বসেন তাঁর ‘দ্য মহাভারত সিক্রেট’ নামের এক উপন্যাসে। ডয়েলের মতে, সেই পর্বটির নাম ‘বিমান পর্ব’। পরে তা কোনও রহস্যময় কারণে ‘মহাভারত’-এর আখ্যান থেকে বাদ যায় বলে ডয়েলের মত।
ডয়েলের উপন্যাসের সূত্র ধরে অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেন ‘বিমান পর্ব’-এর অস্তিত্ব। কেউ কেউ মনে করেন, এটি কোনও স্বতন্ত্র অধ্যায় ছিল না। বরং এটি ছিল কুরক্ষেত্র যুদ্ধে ব্যবহৃত বিশেষ কিছু অস্ত্র ও অস্ত্রবাহী বিমানের (ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধবিমান)-এর খুঁটিনাটি বর্ণনা।
ব্রিটিশ লেখক ও প্রত্নবিদ গ্রাহাম হ্যানককের বিতর্কিত বই ‘ফিঙ্গারপ্রিন্টস অব দ্য গডস’-এও বলা হয়েছে, প্রাচীন বিশ্বে, বিশেষত হারিয়ে যাওয়া মহাদেশ আটলান্টিসে অতি উন্নত সভ্যতা বিরাজ করত। আটলান্টিসের সঙ্গে মহাভারতীয় সমাজের কোনও যোগ থাকতেই পারে— এমন মত পোষণ করেন বেশ কিছু নামজাদা রহস্য সন্ধানী।
আটলান্টিসের ধ্বংসের পিছনে ক্রিয়াশীল ছিল শক্তিশালী কোনও বিস্ফোরণ। এই মত ব্যক্ত করেন প্রাচীন রহস্য সন্ধানীদের একাংশ। গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর দেওয়া বিবরণে এক প্রবল জলোচ্ছ্বাসে এই সভ্যতা এক দিনের মধ্যে ধ্বংস হয়। প্লেটোর বর্ণনাকে অনেকে কল্পনা বলে মনে করলেও বিশ্ব-রহস্যের কারবারিদের মতে, পারমাণবিক বিস্ফোরণ ছাড়া এমন জলোচ্ছ্বাস সম্ভব নয়, যা অতি দ্রুত একটি সভ্যতাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারে।
আটলান্টিসের কাহিনি থেকে যদি আবার চলে আসা যায় ‘মহাভারত’-এ, তবে দেখা যাবে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে এমন কিছু অস্ত্রের বর্ণনা রয়েছে, যা আধুনিক সমরাস্ত্রের সঙ্গে তুলনীয়। ক্রিস্টোফার সি ডয়েল-বর্ণিত ‘বিমান পর্ব’-তেও সেই সব অস্ত্রের ভাঁড়ারের কথা বলা হয়েছিল। এখানে রইল ‘মহাভারত’-এ বর্ণিত কিছু আশ্চর্য অস্ত্রের কথা।
ব্রহ্মাস্ত্র: ‘মহাভারত’ ছাড়াও বেশ কিছু পুরাণে ব্রহ্মাস্ত্রের বর্ণনা পাওয়া যায়। যে কোনও সময়ে ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহারে নিষেধ ছিল। সব অস্ত্র যখন নিঃশেষিত হয়ে যেত, ব্রহ্মাস্ত্র তখনই প্রযুক্ত হত। মানবের অকল্যাণে এই অস্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল। এর প্রয়োগে পূর্বনির্দিষ্ট কোনও লক্ষ্য অনিবার্য ভাবে ধ্বংস হত। বর্ণনা থেকে অনেকেই এটিকে পারমাণবিক অস্ত্রের সঙ্গে তুলনা করেন।
ব্রহ্মশিরাস্ত্র: ব্রহ্মাস্ত্রের থেকে চার গুণ শক্তিশালী বলে এই অস্ত্রকে বর্ণনা করা হয়। জগৎস্রষ্টা ব্রহ্মার চতুর্মুখের শক্তি থেকে এই অস্ত্রের উদ্ভব বলে জানা যায়। এর ধ্বংস-ক্ষমতা মারাত্মক। লক্ষ্যবস্তুর উপরে এই অস্ত্র নাকি উল্কাবৃষ্টি ঘটাত।
নারায়ণী অস্ত্র: বিষ্ণু এই অস্ত্র দান করেছিলেন। এর ধ্বংস-ক্ষমতা আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে তুলনীয়।
ভার্গবাস্ত্র: এই অস্ত্রের শক্তি ব্রহ্মশিরাস্ত্রের অনুরূপ। পুরাণ থেকে জানা যায় ভার্গবাস্ত্র তার লক্ষ্যভেদ করার পরে সেই অঞ্চল ভস্মে পরিণত হত।
পাশুপতাস্ত্র: পশুপতি, অর্থাৎ শিব কর্তৃক প্রদত্ত অস্ত্র। শিব এই অস্ত্র অর্জুনকে দান করেন। ‘মহাভারত’-এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, এটি ব্রহ্মাস্ত্র, নারায়ণাস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র (অগ্নি কর্তৃক প্রদত্ত অস্ত্র) বা বরুণাস্ত্র (জলদেবতা বরুণ কর্তৃক প্রদত্ত অস্ত্র) অপেক্ষা শক্তিশালী। এই অস্ত্র চোখের ইশারাতেও চালনা করা যেত। এই বর্ণনা আজকের পুরাণবিদদের অনেককেই এ কথা ভাবতে বাধ্য করে যে, এটি প্রয়োগকর্তার চোখের দ্বারা নিয়ান্ত্রিত হত (সেন্সোমোটোরিক যন্ত্রের মতো)।
‘মহাভারত’-এর কালে দ্বাপর যুগের অন্ত ঘটে ও কলিযুগ আরম্ভ হয় বলে বেদব্যাস জানিয়েছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু, নৈতিকতার চুড়ান্ত বিলয়, ধ্বংসের ভয়াবহ পরিণতির পরে নবযুগের সূচনা ঘটে। এই সব অস্ত্র ও শক্তির কথা তো সর্বাত্মক ধ্বংস ও বিলয়ের দিকেই ইঙ্গিত করে! তা হলে সেই যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রের পিছনে কি ছিল পরমাণুশক্তির মতো কোনও মহাশক্তির প্রণোদন? আজও এই সব প্রশ্ন বিস্মিত করে ‘মহাভারত’-এর পাঠকদের।