রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর ইংল্যান্ডের রাজা হলেন তৃতীয় চার্লস। মাথায় ‘সেন্ট এডওয়ার্ড’স ক্রাউন’ পরিয়ে রাজ্যাভিষেক হয় তাঁর। সাধারণত রাজ্যাভিষেকের সময় এই মুকুট পরানো হয় ব্রিটেনের সম্রাট বা সম্রাজ্ঞীকে। এই মুকুটের থেকে অনেক বেশি পরিচিত ‘ইম্পেরিয়াল স্টেট ক্রাউন’। অভিষেকের দিন শেষ দিকে এই মুকুটই মাথায় পরেছিলেন চার্লস। সেই মুকুটের এক পাথর নাকি অভিশপ্ত! এমনটাই মনে করেন অনেকে। তবে অনেকের দাবি, এই পাথর নাকি ভাগ্যও বদলে দিয়েছে বহু সম্রাটের।
এই ইম্পেরিয়াল স্টেট ক্রাউন আদতে সার্বভৌমত্বের প্রতীক। ১৯৫৩ সালে নিজের অভিষেকের দিন এই মুকুটই মাথায় পরেছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। শুধু ওই দিন নয়, নিজের শাসনকালে আরও অনেক সরকারি কর্মসূচিতে ওই মুকুট পরেছিলেন রানি।
২০১৬ সালে সংসদের এক কর্মসূচিতে এই মুকুট আর মাথায় পরেননি রানি। পাশে একটি নরম বালিশের উপর রাখা ছিল মণিমুক্তোখচিত সেই মুকুট। সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছিল, ২,৯০১টি রত্নখচিত ওই মুকুটের ওজন প্রায় দেড় কেজির মতো। অত ভারী মুকুট তাই রানি আর মাথায় পরেননি।
একটি তথ্যচিত্রে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় অতীতে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ বলেছিলেন, ‘‘মাথায় ওই মুকুট থাকলে মাথা নিচু করে কিছু পড়া সম্ভব নয়। তার ভারে ঘাড় ভেঙে যেতে পারে। মাথা থেকে মুকুট খুলে পড়ে যেতে পারে। তাই বক্তৃতা লেখা কাগজ চোখের সামনে তুলে ধরতে পড়তে হয়।’’
রানি নিজেই সেই সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, মুকুটের কিছু অসুবিধা রয়েছে। তবে, তা বলে সেই মুকুটের গুরুত্ব কিছু কম নয়।
এই ‘ইম্পেরিয়াল’ মুকুট যে গুরুত্বপূর্ণ, তা আর নতুন করে বলতে হয় না। প্রায় তিন হাজার মণিমাণিক্য রয়েছে এতে। এই মুকুটে রয়েছে রাজা অষ্টম এডওয়ার্ডকে দেওয়া হিরে। ১৯০৯ সালে রাজাকে উপহার দেওয়া হয়েছিল সেই ৩১৭.১৪ ক্যারেটের হিরে।
মুকুটে রয়েছে সেন্ট এডওয়ার্ডের নীলা। এককালে মুকুটের সামনে বসানো থাকলেও এখন তার পিছনে রয়েছে ‘স্টুয়ার্ট নীলা’। আর রয়েছে ‘কালো যুবরাজের চুনি’ (ব্ল্যাক প্রিন্সেস রুবি)। এই নিয়েই রয়েছে হরেক গল্প।
১৬৬০ সাল থেকে এই মুকুটের নকশা বার বার পাল্টানো হয়েছে। ১৮৩৮ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার জন্য এই মুকুটের নকশা ফের বদল করা হয়। তখন থেকে মুকুটের সামনে রয়েছে এই ‘কালো যুবরাজের চুনি’।
লাল এই পাথরকে চুনি বলা হলেও আদতে তা ১৭০ ক্যারেটের একটি স্পিনেল। কেন স্পিনেল হওয়া সত্ত্বেও চুনি (রুবি) বলে পরিচিত হয়ে আসছে এই বিখ্যাত পাথর? ১৭৮৩ সালের আগে স্পিনেল এবং চুনির ফারাক করতে জানতেন না মানুষ। তাই ‘কৃষ্ণাঙ্গ যুবরাজের চুনি’ নামেই পরিচিত হতে থাকে এই মহামূল্যবান পাথর।
মনে করা হয়, ১৩০০ সালের আশপাশে মাটি খনন করে বার করা হয়েছিল এই চুনি। মধ্য এশিয়ার হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল থেকে। সম্ভবত, বাদাখশান অঞ্চল থেকে উত্তোলন করা হয়েছিল চুনিটি।
অনেক বছর আগে রেশম পথ দিয়ে চিন থেকে পশ্চিম এশিয়ায় বাণিজ্য করতে যেতেন মানুষ। তার পর পশ্চিম এশিয়া থেকে যেতেন আফ্রিকা এবং ইউরোপে। ওই ব্যবসায়ীরা স্পিনেল, চুনি কিনে বিক্রি করতেন। ইটালীয় ব্যবসায়ী তথা পর্যটক মার্কো পোলোও বাদাখশানের চুনির কথা উল্লেখ করেছিলেন।
১৩৬০ সাল নাগাদ গ্রানাডাতে প্রথম উল্লেখ মেলে কৃষ্ণাঙ্গ যুবরাজের চুনির। গ্রানাডা তখন ছিল এক স্বাধীন দেশ। এখন স্পেনে রয়েছে সেই গ্রানাডা। সেই দেশের রাজা চতুর্থ সুলতান মহম্মদের কাছে ছিল সেই চুনি।
১৩৬২ সালে সিংহাসনচ্যুত হন সুলতান মহম্মদ। তিনি গ্রানাডা ছেড়ে সেভিলে পালিয়ে যান। সঙ্গে নিয়ে যান সেই স্পিনেল-সহ বেশ কিছু মূল্যবান ধনরত্ন। যদিও স্থায়ী হয়নি সেই সম্পদ।
সেভিলে গিয়ে সেখানকার সম্রাট পেড্রোর কাছে সাহায্য চান। নিজের সাম্রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্য সেখানকার সম্রাট পেড্রোর দ্বারস্থ হন। গ্রানাডার নতুন সুলনতান যদিও ছিলেন পেড্রোর বন্ধু। তিনি পাল্টা মহম্মদকেই খুন করেন।
মহম্মদের কাছে থাকা সেই কৃষ্ণাঙ্গ যুবরাজের চুনিও কেড়ে নেন। ইতিহাসবিদদের একাংশ মনে করেন, সুলতান মহম্মদের মতো সেই চুনি পেড্রোর জীবনেও নাকি দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছিল।
চুনি হাতে পাওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই পেড্রোর ভাই এনরিক তাঁকে উৎখাতের চেষ্টা করেন। পেড্রো ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ডের কাছে সাহায্যের আবেদন করেন।
রাজা এডওয়ার্ড মধ্যস্থতার জন্য ছেলে এডওয়ার্ড অফ উডস্টককে পাঠান সেভিলে। এই এডওয়ার্ড যুদ্ধক্ষেত্রে এতটাই নিষ্ঠুর ছিলেন যে, তাঁকে বলা হত কৃষ্ণাঙ্গ বা কালো যুবরাজ।
পেড্রোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে এনরিককে দমন করেন এডওয়ার্ড। প্রচুর সেনা দিয়ে সাহায্য করেন। পরিবর্তে পেড্রোর থেকে নেন সেই চুনি। তখনকার মতো পেড্রো জয় পেলেও দু’বছর পর তাঁকে সরিয়ে সিংহাসন দখল করেন এনরিক।
ব্রিটিশ যুবরাজ এডওয়ার্ডের হাতে সেই চুনি আসার পর তার নাম হয় কৃষ্ণাঙ্গ যুবরাজের চুনি। এর পর বংশানুক্রমে ইংল্যান্ডের সম্রাট-সম্রাজ্ঞীদের হাতে যায় সেই চুনি।
এই চুনি কিন্তু ইংল্যান্ডের রাজাদের হাতে এসে তাঁদের ভাগ্য বদলে সাহায্য করেছে। দু’বার প্রাণরক্ষা করেছে দুই সম্রাটের। পঞ্চম হেনরি এজিনকোর্টে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন। তাঁর শিরোস্ত্রাণে ছিল সেই চুনি। মাথায় আঘাত করেছিলেন শত্রু। বেঁচে যান তিনি। এমনকি সেই চুনিও ছিল অটুট।
একই ভাবে বসওয়ার্থের যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে এই চুনির জোরে প্রাণে বেঁচেছিলেন রাজা তৃতীয় রিচার্ড। তার পর কয়েক বছর এই চুনির সম্পর্কে আর কিছু লেখা নেই ইতিহাসে। ১৬৬০ সালে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসেন দ্বিতীয় চার্লস। তাঁর তোশাখানায় থাকা সামগ্রীর মধ্যে এই চুনির উল্লেখ মেলে। ক্রমে বংশপরস্পরায় হাতবদল হয়েছে এই চুনি। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের শেষযাত্রাতেও সামিল হয়েছিল চুনি বসানো সেই বিখ্যাত মুকুট।