‘জলেবি বাই’-এ মুম্বইয়ের মল্লিকা শেরাওয়াত কোমর দোলালে হিট আর সোদপুরের সোনালি (নাম পরিবর্তিত) ‘রসগোল্লা’য় নাচলেই গরম রডের ছ্যাঁকা! তারকা নন বলেই কি সমাজ ঘাড় ধরে তাঁদের সহবৎ শেখাবে? আর জুলজুল চোখে দেখবে মল্লিকা-মালাইকাদের শরীর! খড়দহের ঘটনার পর সমাজের নীতি পুলিশি নিয়ে এই প্রশ্ন তুলেছেন আক্রান্তরাই।
আদিরসের ইঙ্গিতবহ গানে খোলামেলা পোশাকে নেচে ইউটিউবে ভিডিয়ো আপলোড করেছিলেন দুই তরুণী। সেই ভিডিয়োর জন্য গত কয়েক দিন ধরেই অনলাইনে হুমকি আসছিল দু’জনের কাছে। দুই তরুণী জানিয়েছেন, ওই সব হুমকিতে অনেকেই তাদের তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জানতে চেয়েছেন, ‘‘এ সব কী? নিজেদের সেলিব্রিটি ভাবছ নাকি!’’
সেই চোখ রাঙানিতেও কাজ না হলে সম্প্রতি শারীরিক হামলা করা হয় ওই দুই তরুণীর উপর। রাস্তার মাঝখানে গরম লোহার রড দিয়ে মারধর করা হয় দু’জনকেই। তাতে একজনের মাথায় এবং কানে আঘাত লাগে। মাথার ভিতরে রক্তপাত হয় বলেও অনুমান। অন্যজনের শরীরে বেশ কিছু অংশ পুড়ে যায়।
সোদপুরের দুই তরুণী নেটমাধ্যমে খোলামেলা পোশাকের ছবি এবং ভিডিয়ো প্রকাশ করছেন দীর্ঘদিন ধরেই। তাঁদের অভিযোগ, ওই ধরনের ছবি প্রকাশ করার জন্য ইদানীং প্রাণে মারার হুমকিও পাচ্ছিলেন তাঁরা। তাঁদের প্রশ্ন, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও কি প্রাপ্য স্বাধীনতা পাবেন না? সমাজই তাঁদের ভাল মন্দের বিচার করে এ ভাবে বিনা বাধায় শাস্তি দিতে থাকবে! আর তাঁরা ভয় পেয়ে ঘরবন্দি হয়ে থাকবেন?
বস্তুত, ভয় দেখিয়ে সহবৎ শেখানোর এই নজির এর আগেও দেখেছে দেশ। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, দেশের বহু রাজ্যে এমন ঘটনা ঘটেই চলেছে। তার মধ্যে কিছু কিছু ‘শাস্তি’র বহর দেখলে শিউরে উঠতে হয়।
নব্বইয়ের দশকে জম্মু এবং কাশ্মীরের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী মহিলা সংগঠন ফতোয়া জারি করে, রাজ্যের মেয়েরা মুখ না ঢাকলে তাদের উপর অ্যাসিড হামলা করা হবে। মেয়েরা সেই ফতোয়া মানছে কি না, তা দেখতে দীর্ঘদিন ধরে কাশ্মীরের সিনেমাহল, দোকানপাট, রেস্তরাঁয় নজরদারদের নিয়মিত হানাও চলেছিল সেই সময়।
১৯৯৬ সালে বিশ্বসুন্দরীর প্রতিযোগিতার আসর বসেছিল বেঙ্গালুরুতে। সেই প্রতিযোগিতাও নীতি নজরদারদের কোপে পড়ে। বিজেপি কর্মী-সহ হাজার হাজার বিক্ষোভকারী বিক্ষোভ দেখান। প্রতিবাদে গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মঘাতীও হন এক বিক্ষোভকারী। পুলিশ দেড় হাজার বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করে সেই ঘটনায়।
ভারতীয় নীতি পুলিশির শিকার হন লেখিকা অরুন্ধতী রায়ও। তাঁর লেখা বই ‘দ্য গড অফ স্মল থিংস’-এর ২১ নম্বর অধ্যায়ে আপত্তিকর এবং যৌন উত্তেজক বর্ণনা রয়েছে বলে অভিযোগ করে একটি মামলা দায়ের করেছিলেন কেরলের এক আইনজীবী।
পাবে বসে মদ্যপান অনেকের কাছেই স্বাভাবিক এবং সাধারণ মনে হতে পারে, তবে ২০০৫ সালে শুধু এই সংস্কৃতির বিরোধিতা করেই পুণের একটি পাবে ভাঙচুর চালিয়েছিল নীতি নজরদাররা। ঠিক পাব বন্ধ হওয়ার সময় রাত সারে ১২টায় মহারাষ্ট্রের ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির সদস্যরা ধ্বংসলীলা চালান ওই পাবে।
একই ধরনের ঘটনা ঘটে ২০০৯ সালে ম্যাঙ্গালোরে। তবে এ বার পাবে ভাঙচূড় চালানোর পাশাপাশি, যারা সেখানে ছিলেন, পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে তাদের প্রত্যেককেই প্রবল মারধর করে একদল নীতি নজরদার। বিশেষ মদ্যপানরত মহিলাদের সবার সামনে থাপ্পড় মারা হয়। মাটিতে ফেলে লাথিও মারা হয়। ঘটনাটি নিয়ে গোটা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
২০১৪ সালে কেরলের এক যুবকের মৃত্যু হয় এই নীতি নজরদারদের জেরে। এক মহিলার বাড়িতে তাকে পাওয়া যায়। ঘটনাটিকে অবৈধ আখ্যা দিয়ে স্থানীয়রা মারধর করে মেরে ফেলেন ওই যুবককে।
২০১৮ সালে অসমের নগাঁওয়ে এক যুগলকে রাতভর মারধর করা হয় অবৈধ সম্পর্ক রাখার অভিযোগে। পরে আরও বেশি শাস্তি দিতে গ্রামবাসীরা সবার সামনে মহিলার মাথা মুড়িয়ে জামা কাপড় ছিঁড়ে পুলিশের হাতে তুলে দেন দু’জনকে।
প্রকাশ্যে ঘনিষ্ঠ হওয়ায় প্রেমিক-প্রেমিকাকে মারধর করে হাসপাতালে পাঠানোর ঘটনাও ঘটেছে। মহারাষ্ট্রের লাতুরে হামলাকারীরা গোটা ঘটনাটির ভিডিয়ো রেকর্ডিং করে তা হোয়াটসঅ্যাপে শেয়ারও করেন।
উত্তরপ্রদেশ প্রশাসনের বিরুদ্ধেও নীতি পুলিশির অভিযোগ ওঠে। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়ালেই সরকার পুরুষদের কড়া শাস্তি দেবে বলে ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ।
কিছু দিন আগে এই উত্তরপ্রদেশেরই অযোধ্যায় এক ব্যক্তি নীতি নজরদারদের কোপে পড়েন, স্ত্রীকে প্রকাশ্যে চুম্বন করার জন্য। সরযূ নদীতে স্নান করছিলেন দু’জনে। সেই সময়ই পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হন। তার পরই তাকে ঘিরে ধরে মারধর করেন একদল ব্যক্তি। তাঁদের বলতে শোনা যায়, অযোধ্যায় এ সব বরদাস্ত করা হবে না।
সুতরাং নীতি পুলিশির এই ধারা ভারতে দীর্ঘদিন ধরে চলছে। ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র দিন যুগলকে ধরে মালাবদল করে বিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে এখনও।
খড়দহের ঘটনা এবং তাতে আক্রান্তরা যে প্রশ্ন তুলেছেন, তা-ও ভাবনার খোরাক দেয়। কারণ যে দেশের সিনেমায় রমরমিয় চলে যৌনদৃশ্য, যে দেশ প্রাপ্ত বয়স্কদের ছবি দেখার পরিসংখ্যানে বিশ্বে প্রথম দশের তালিকায় রয়েছে, সেখানে যৌনতা এবং তৎসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে এই ছুৎমার্গও কি যথাযথ!