প্রায় দু’দশক আগে হাসপাতালের বিল মেটানোর জন্য স্থানীয় এক ভূস্বামীর কাছ থেকে সামান্য কিছু টাকা ধার করেছিলেন পাকিস্তানের এক মেঘওয়ার পরিবার। তার পর থেকেই দাসত্বের জাঁতাকলে বন্দি সেই পরিবারের সদস্যেরা। শোষণ এবং দলিতদের উপর হওয়া অত্যাচারের অন্যতম নিদর্শন হয়ে তাঁরা রয়ে গিয়েছেন পাকিস্তানে।
মেঘওয়ার ভিল বা সিন্ধি ভিল নামে পরিচিত মেঘওয়ার সম্প্রদায়ের বসবাস পাকিস্তানের সিন্ধু, পঞ্জাব এবং বালুচিস্তানে। এই সম্প্রদায় পাকিস্তানে থাকা গুটিকয়েক হিন্দু সম্প্রদায়গুলির মধ্যে অন্যতম। পাকিস্তানে এদের পরিচিতি ‘দলিত’ হিসাবে।
সিন্ধে বসবাসকারী মেঘওয়ারদের মধ্যে সে রকমই এক পরিবার বাসন্তী মেঘওয়ারের। বছর তেইশ আগে বাসন্তী এবং তাঁর ছেলে পুঞ্জো মেঘওয়ার স্থানীয় এক ভূস্বামীর কাছে সামান্য কিছু টাকা ধার করেছিলেন হাসপাতালের বকেয়া বিল মেটানোর জন্য।
তার পর থেকেই বাসন্তী, পুঞ্জো, পুঞ্জোর স্ত্রী, পুঞ্জোর ১২ বছর বয়সি পুত্র দিলীপ প্রত্যেকেই ওই ভূস্বামীর ইটভাটার কর্মী।
প্রতি দিন থর মরুভূমি সংলগ্ন এই ইটভাটায় পরিশ্রম করার পর পুঞ্জো এবং তাঁর পরিবারের হাতে টেনেটুনে ৪০০ টাকা আসে। এর মধ্যে ২০০ টাকা ধারের সুদ হিসাবে কেটে নেন ভূস্বামী।
ভূস্বামীর কাছ থেকে ২৩ বছর আগে আঙুলের ছাপ দিয়ে টাকা ধার নিয়েছিলেন পুঞ্জো। সেই টাকার উপর কত সুদ চাপানো হয়েছিল বা চুক্তিপত্রে কী লেখা ছিল, তা জানেই না পুঞ্জোর পরিবার। শুধু জানেন, টাকা এখনও শোধ হয়নি।
ভূস্বামীর কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়ার পর থেকে সেই চুক্তিপত্র চোখে দেখেননি পুঞ্জো। ওই মেরওয়ার পরিবার শুধু জানে, ভূস্বামী এখনও তাঁর কাছে ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৫০ হাজার টাকা পাবেন। ওই ভূস্বামী প্রতি মাসে এসে পুঞ্জোদের বলে যান, ‘‘ঋণ শোধ হতে অনেক বাকি। এখনও কাজ চালিয়ে যেতে হবে।’’
মেঘওয়ার পরিবার যে ইট তৈরি করে, তা বিক্রি করে এক মাসেই ৫০ হাজার আয় করেন ভূস্বামী। কিন্তু পুঞ্জোদের ঘাড় থেকে ঋণের বোঝা নামে না।
পুঞ্জো, তাঁর ৭০ বছর বয়সি মা, পুত্র দিলীপ প্রতি দিন ভোর থেকে উঠে ইট তৈরির কাজে হাত লাগান। সারা দিন ধুলো ওড়ানো খাঁ-খাঁ জমির মধ্যে চলে কাজ। মাঝে শুধু খাওয়ার সময়টুকু পান। সন্ধ্যার আগে পর্যন্ত সেই কাজ চলে।
মাটি কাটা, জল ঢালা, কাদা তৈরি করা, ইট তৈরি করা, সব দায়িত্বই এই পরিবারের ঘাড়়ে। কাজ সেরে সকলে ফিরে যান ইটভাটারই কোণে এক কামরার ছোট ঘরে। সেই ঘরেই কোনও রকমে দিন গুজরান করতে হয় তাঁদের।
ইট তৈরিতে কায়িক শ্রম বেশি। সহজেই শরীর ক্লান্ত হয়ে যায়। তবুও ভাটার গনগনে আগুনের সামনে সারা দিন ইট তৈরি করে যেতে হয় পুঞ্জোকে। ২০২২ সালের জুলাই মাসে, জ্বলন্ত ভাটায় পড়ে মারা যান পুঞ্জোদের মতোই তিন শ্রমিক। তবুও প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে যেতে হয় তাঁদের। ছাড় পায় না পুঞ্জোর কিশোর পুত্র দিলীপও।
মাটি থেকে ইট তৈরিতে প্রায় এক মাস সময় লাগে। ইট পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেলে সেগুলি বড় বড় ইমারত থেকে শুরু করে সেতু তৈরির কাজে লাগে। পাকিস্তানে অনেক টাকার খেলা চলে ইট বিক্রি নিয়ে। তবে মেরওয়ার পরিবারের অবস্থা ফেরে না।
এক সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় কেঁদে ফেলেন পুঞ্জো। তিনি বলেন, ‘‘আমি জানি না কবে এই নরকযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাব! কবেই বা ঋণ পরিশোধ হবে। এই যন্ত্রণা আর সহ্য করা যাচ্ছে না। ছেলেটাকে প্রতি দিন চোখের সামনে একটু একটু করে শেষ হয়ে যেতে দেখছি।’’
পাকিস্তানে শিশুশ্রম অবৈধ। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, পাকিস্তানের ইটভাটা শ্রমিকদের তিন জনের মধ্যে এক জন নাবালক।
পুঞ্জোর ছেলে দিলীপের কথায়, ‘‘আমার ১২ বছর বয়স হয়েছে। আমি এখনও লিখতে-পড়তে পারি না। সারা দিন ধরে কাজ করে কোমরে, হাতে ব্যথা করে। বাবা ঠিক করে বলতে পারে না এখনও কত দিন কাজ করতে হবে।’’
অতিরিক্ত তাপ ছাড়াও ইটভাটার ধুলোয় শ্বাস নেওয়া বিপজ্জনক। কার্বন মনোক্সাইড এবং সালফারের সংস্পর্শে এসে ইটভাটা কর্মীদের, বিশেষ করে শিশুদের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে বলে জানান চিকিৎসকেরা।
তবে শুধু পুঞ্জোর পরিবার নয়, এমন আরও অনেক পরিবার পাকিস্তানের ইটভাটা মালিকদের খপ্পরে পড়ে ক্রীতদাসদের মতো জীবনযাপন করছে। যেমন করছেন পঞ্জাব প্রদেশের বাসিন্দা রফিক গুলজার।
২০১৮ সালে রফিক তাঁর মেয়ের বিয়ের যৌতুকের টাকা জোগাড় করতে স্থানীয় ইটভাটা মালিকের কাছ টাকা ধার করেছিলেন। টাকার বিনিময়ে তিনি পঞ্জাব প্রদেশের ঝাং জেলার ইটভাটায় প্রতি দিন এক হাজার ইট তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
কয়েক মাস পরে রফিককে লাহৌরের কাছে বাথ গ্রামে আর এক ইটভাটা মালিকের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। থাকার জন্য তাঁর পরিবারকে ইটভাটার সামনেই একটি দু’কামরার ঘর দেওয়া হয়েছিল।
পাকিস্তানে এই ধরনের আধুনিক দিনের দাসত্ব বিরল নয়। ‘গ্লোবাল স্লেভারি ইনডেক্স’ অনুযায়ী, শুধুমাত্র এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে ক্রীতদাসের মতো জীবন কাটাচ্ছেন।
একগুচ্ছ প্রমাণ এবং সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন সত্ত্বেও, সিন্ধু প্রদেশের শ্রম বিভাগ দাবি করে, এমন কোনও দাসত্বের কথা তাঁদের অজানা। বছরের পর বছর ধরে একই পরিবার এবং সেই পরিবারের অপ্রাপ্তবয়স্করা ক্রীতদাসের মতো জীবন কাটাচ্ছেন এমন কোনও সরকারি রেকর্ডও নাকি নেই।
বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইটভাটার মালিকদের সঙ্গে বিশেষ খাতিরের কারণেই নাকি সরকারি খাতায় নাম ওঠে না পুঞ্জো, রফিকদের। তাই শাস্তিও পেতে হয় না ওই ইটভাটা মালিকদের।
জাহিদ থেবো ইটভাটায় শিশুশ্রম নিরীক্ষণের জন্য ‘সোসাইটি ফর দ্য প্রোটেকশন অফ দ্য রাইটস অফ দ্য চাইল্ড (স্পার্ক)’-এর সঙ্গে কাজ করেন। এই অসরকারি সংস্থা দাসত্বের শিকলে আটকে থাকা পরিবারগুলির হয়ে আদালতে মামলা লড়ে।
এখনও অবধি প্রায় ১৭ হাজার মানুষের অবস্থা ফেরাতে সাহায্য করেছে স্পার্ক। জাহিদ বলেন, ‘‘যখন কেউ মুক্তি পান, তাঁদের মুখে হাসি-আনন্দ দেখে, ছোট বাচ্চাদের উজ্জ্বল মুখ দেখে আমরা মানসিক তৃপ্তি পাই। এর থেকে বেশি মানসিক শান্তি আর কোনও কিছুতে নেই।’’
ইটভাটা মালিক এবং ভূস্বামীদের থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আজাদ নগরের একটি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পরিবারগুলি ভাটায় কাজ করে মজুরি উপার্জন করতে সক্ষম হলেও তাদের কাউকে টাকা দিতে হয় না।
আজাদ নগরের বাসিন্দাদের অনেকেই বলছেন, দাসত্বের চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পেরে তাঁরা নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন। তবে ক্যাম্পে জলের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। শিশুদের জন্য স্কুলও নেই। স্পার্ক-এর তরফে সরকারের কাছে আর্থিক সাহায্যের আবেদন জানানো হয়েছে।