সরকারি আমলা হওয়ার পরীক্ষায় সফলদের তালিকায় ছিল তাঁর নাম। দেশের কাজে তাঁর বহু উদ্যোগ প্রশংসিত। অথচ আইএএস অফিসার অনন্যা দাস তাঁর মেধা বা কৃতিত্বের জন্য খবরে আসেননি। তাঁর কথা দেশবাসী জেনেছিলেন সম্পূর্ণ অন্য একটি কারণে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের সমস্ত সংবাদমাধ্যমেই প্রকাশিত হয় তাঁকে নিয়ে সেই খবর। শিরোনাম ছিল, ‘‘টিনা দাবির পর আরও এক মহিলা আইএএস অফিসার দ্বিতীয় বার বিয়ে করছেন।’’
তারকা আইএএস কর্তা হিসেবে জনপ্রিয় টিনা। ইউপিএসসি পরীক্ষায় দেশে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন তিনি। ঘটনাচক্রে, কৃতী আইএএস অফিসার অনন্যার তাঁর সঙ্গে আরও একটি মিল আছে। অনন্যাও টিনার মত প্রথম বিয়ে করেছিলেন এক আইএএস কর্তাকে। টিনার মতো সেই বিয়ে ভেঙে যায় তাঁরও।
এর পর দ্বিতীয় বার প্রেমে পড়েন অনন্যা। এই দ্বিতীয় জনও আইএএস অফিসার। দু’জনেই একই রাজ্যের দুই জেলার জেলাশাসক। এখানেও টিনার সঙ্গে তাঁর মিল। স্বাভাবিক ভাবেই খবরে সেই প্রসঙ্গ উঠেছিল। প্রকাশ্যে এসেছিল অনন্যা এবং তাঁর স্বামী চঞ্চল রানার ব্যক্তিগত জীবন।
দু’জনেই এর আগে বিয়ে করেছিলেন দুই জেলাশাসককে। অনন্যার সঙ্গে বিয়ে হয় ওড়িশার কোরাপুটের জেলাশাসক আবদাল আখতারের। রানার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ওড়িশারই রায়গড়ের জেলাশাসক স্বাধা দেব সিংহের সঙ্গে। কিন্তু দু’জনেরই প্রথম বিয়ে বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
বছর কয়েক আগে আলাপ হয় দু’জনের। গত ফেব্রুয়ারিতে বাগ্দান হয় অনন্যা এবং চঞ্চলের। মে মাসে বিয়ে করেন দু’জনে। তাঁদের বিয়ের অনুষ্ঠানের ছবিও ভাইরাল হয়েছিল সমাজমাধ্যমে।
বিয়ে, সম্পর্কের জন্য বার বার খবরে আসা এই আইএএস কর্তার জীবনে কিন্তু কৃতিত্বের কমতি নেই। ইউপিএসসি পরীক্ষায় প্রথম বার বসে প্রথম বারেই পাশ করেন।
শুধু তা-ই নয়, ইউপিএসসিতে অনন্যার প্রাপ্ত নম্বর ছিল ৯৯৪। গোটা দেশের লক্ষ লক্ষ পরীক্ষার্থীকে পিছনে ফেলে ১৬তম স্থান অধিকার করেছিলেন তিনি। তা-ও প্রথম চেষ্টাতেই।
সরকারি আমলা হওয়ার পরীক্ষায় অনেকেই বার বার পরীক্ষা দিয়ে তার পর সাফল্য পান। অনন্যা অবশ্য সাফল্য পেয়েছিলেন মাত্র এক বছরের প্রস্তুতিতেই।
ছাত্রী হিসাবে বরাবর ছিলেন মেধাবী। বিজ্ঞান এবং অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় ৯৬.২০ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলেন অনন্যা।
বাড়ি অসমের গুয়াহাটিতে। বয়স ৩৩। তবে আমলা হওয়ার পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হন ২৫ বছর বয়সেই।
বাবা অসিতবরণ দাস রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী। বদলির চাকরির জন্য ছোটবেলায় প্রায়ই স্কুল বদলেছে অনন্যার। গুয়াহাটি ছাড়াও পটনা এবং কলকাতার স্কুলে পড়েছেন তিনি। মাদ্রাজের আইআইটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পাশ করার পর অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পড়তে রাজস্থানে যান।
দু’বোনের মধ্যে অনন্যাই বড়। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁকে পড়াশোনার ব্যাপারে নানা ভাবে সাহায্য করেছে তাঁর পরিবার। তবে মা আনিতা দাস সবচেয়ে বেশি পাশে থেকেছেন।
রাজস্থানে অর্থনীতি নিয়ে এমএসসি পড়তে পড়তেই রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ায় এগ্জ়িকিউটিভ শিক্ষানবিশ হিসাবে কাজ শুরু করেন অনন্যা। এর পর একটি বহুজাতিক আইটি সংস্থায় ভাল চাকরি পান। তবে সেই চাকরি বেশি দিন করেননি তিনি।
অনন্যা জানিয়েছেন, চাকরি করতে ভাল লাগছিল না তাঁর। তাই চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। টুকটাক সমাজসেবামূলক কাজ করতেন। এর পর ঠিক করেন দেশের সংস্কারের কাজ করবেন।
নামী সংস্থার চাকরি আচমকাই ছেড়ে দেন। শুরু করেন সরকারি আমলা হওয়ার পরীক্ষা ইউপিএসসির জন্য প্রস্তুতি। অনেকেই সেই সময় অনন্যার চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছিলেন। অনন্যা তাতে কান দেননি।
ইউপিএসসির জন্য এক বছরেরও কম সময় প্রস্তুতি নেন অনন্যা। ২০১৪ সালের মাঝামাঝি দিল্লি যান। রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন। অগস্টে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় পাশ করেন। ডিসেম্বরে বসেন মূল লেখার পরীক্ষায়। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালের মার্চ এপ্রিলে হয় ইন্টারভিউ। তার পরেই প্রকাশিত হয় রেজাল্ট। দেশের মধ্যে ১৬তম স্থান অধিকার করেন তিনি।
২০১৫ সালের ব্যাচের গুজরাত ক্যাডারের আইএএস অফিসার তিনি। ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ-সহ বহু রাজ্যের উপজেলাশাসক এবং জেলাশাসকের দায়িত্ব পালন করেছেন অনন্যা। মহিলা এবং শিশু কল্যাণে অনন্যার কাজ প্রশংসিত হয়েছে বিভিন্ন মহলে।
কোভিডের বছরে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুরের দায়িত্ব নিয়ে এসেছিলেন অনন্যা। কোভিড মোকাবিলায় অনন্যার কাজ প্রশংসিত হয় সেখানেও।
আপাতত তিনি ওড়িশায় কর্মরত। কটক মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের কমিশনার হিসাবে দীর্ঘ দিন দায়িত্ব পালন করেছেন। এই পদে অনন্যার কাজ এবং নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা প্রশংসিত হয়। এর পর তাঁর পদোন্নতি হয় সম্বলপুরের জেলাশাসক হিসাবে। আবার একই সঙ্গে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্বও দেওয়া হয় তাঁকে।
একনিষ্ঠ ভাবে কাজ করার জন্য বহু সম্মান পেয়েছেন অসমের এই কন্যা। ২০২০ সালে ওড়িশার লিভিং লেজেন্ড সম্মানও দেওয়া হয় অনন্যাকে।
স্বপ্ন দেখলে এবং সেই স্বপ্নকে সত্যি করার নিষ্ঠা এবং একাগ্রতা থাকলে যে আকাশ ছোঁয়া যায়, তার প্রমাণ অনন্যার সাফল্য। স্বপ্নের পিছনে ছুটতে গিয়ে বহুজাতিক সংস্থার ভাল চাকরিকেও রেয়াত করেননি তিনি।