পাঁচ মিনিটের ঝড়। রবিবার বিকেলে তাতেই লন্ডভন্ড হয়ে গেল জলপাইগুড়ি, কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ার— উত্তরবঙ্গের এই তিন জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। প্রশাসনিক সূত্রে খবর, রবিবার বিকেলের ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জলপাইগুড়ি শহর, ধূপগুড়ি, ময়নাগুড়ি।
ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে জলপাইগুড়ি শহর সংলগ্ন পাহাড়পুর গ্রাম পঞ্চায়েতের পাতকাটা ও ময়নাগুড়ি এলাকার ডেঙ্গুয়াঝাড় চা বাগান ও ধূপগুড়ি। অনেকেই আহত। ঘরদোর লন্ডভন্ড হয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন বহু।
ঝড়ে লন্ডভন্ড কোচবিহারের মাথাভাঙার বিস্তীর্ণ অঞ্চলও। রবিবার সন্ধ্যায় ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মাথাভাঙার ১ নম্বর ব্লকের শিকারপুর, কুর্শামারি, এলংমারি-সহ একাধিক এলাকা। জানা যায়, ঝড়ের তাণ্ডবে কমপক্ষে ২০০ বাড়ি ভেঙে গিয়েছে। ভেঙেছে বহু গাছও।
ঝড়ের তাণ্ডবে জলপাইগুড়িতে মৃত্যু হয়েছে পাঁচ জনের। নিহতদের মধ্যে দু’জন জলপাইগুড়ি শহরের বাসিন্দা। এক জন গোসালা মোড়ের বাসিন্দা। আর এক জন সেন পাড়া। বাকি দু’জন ময়নাগুড়ির বার্নিশ এলাকার বাসিন্দা।
কোচবিহারে ঝড়ের প্রকোপে ভেঙে পড়ে রাস্তার পাশে থাকা বিদ্যুতের খুঁটি এবং ট্রান্সফরমার। এই ঘটনার পরেই গোটা এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ঝড়ের প্রকোপে আহত হন বেশ কয়েক জন। আহতদের উদ্ধার করে মাথাভাঙা মমহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
মাথাভাঙা এক নম্বর ব্লকের বিডিও শুভজিৎ মণ্ডল রবিবার বলেন, “গ্রাম পঞ্চায়েতগুলি থেকে ক্ষয়ক্ষতির রিপোর্ট নেওয়া হচ্ছে। সোমবারের মধ্যে তাঁদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টাও করা হচ্ছে।”
সোমবারও জলপাইগুড়িতে ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আলিপুর আবহাওয়া দফতর। শুধু জলপাইগুড়িই নয়, উত্তরবঙ্গের আরও চার জেলা আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং, কালিম্পং ও কোচবিহারেও ঝড়বৃষ্টি হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে হাওয়া অফিস।
আবহাওয়া দফতরের তরফে সোমনাথ দত্ত জানান, সোমবার উত্তরবঙ্গের পাঁচ জেলায় বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। সঙ্গে ৩০-৪০ কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো হাওয়া বইতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে রবিবার রাতেই উত্তরবঙ্গে পৌঁছন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জলপাইগুড়ি শহরের গোসালা মোড়ে অনিমা রায় নামে এক মহিলা ঘূর্ণিঝড়ের বলি হয়েছেন। জলপাইগুড়ি পৌঁছে রাতেই তাঁর বাড়িতে যান মুখ্যমন্ত্রী। তার পর আহতদের দেখতে মৃতার বাড়ি থেকে সোজা জলপাইগুড়ি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছন তিনি।
রবিবার রাতে বাগডোগরা বিমানবন্দরে নেমে মমতা বলেন, ‘‘রাজ্য সরকার পাশে আছে। এখন যে হেতু আদর্শ নির্বাচনী আচরণবিধি (এমসিসি) চলছে, তাই প্রশাসন যা করার করবে। একটা বাচ্চাকে নেওটিয়া হাসপাতালে আনা হচ্ছে, ওটা অভিষেক এসে দেখে নেবে। প্রশাসন যা করার করবে। সবটা এখানে বলছি না।’’
রাতে তিনি আরও জানান, পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য প্রশাসন যা করার করছে। ত্রাণ সরবরাহের কাজ চলছে। এ ছাড়া, জেলা ও ব্লক প্রশাসন, পুলিশ, ডিএমজি এবং কুইক রেসপন্স টিম বিপর্যয় মোকাবিলায় কাজ করছে। ক্ষতিগ্রস্তদের নিরাপদ এলাকায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাত জেগে সেই কাজের তদারকিও করেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী।
রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসও রাজভবনে ‘ইমার্জেন্সি সেল’ চালু করেছেন। তিনিও সোমবার ভোরে জলপাইগুড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। কলকাতা বিমানবন্দর থেকে জলপাইগুড়ির ঘটনায় শোকপ্রকাশ করেন রাজ্যপাল। যাঁরা এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান তিনি। রাজ্যপাল বলেন, ‘‘সকলে একসঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলার কাজ করছেন। আমি ওখানে গিয়ে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখব, মানুষের সঙ্গে কথা বলব। যা যা করা সম্ভব, করব।’’
সোমবার সকালে জলপাইগুড়ি পৌঁছেছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। এ ছাড়া বিকেলে সেখানে যাওয়ার কথা তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। রবিবার রাতেই নিজের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে একটি পোস্ট করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী লেখেন, “পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি-ময়নাগুড়ি এলাকায় ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বহু পরিবার। এই ঝড়ে অনেকেই তাঁদের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন। তাঁদের প্রতি আমার সমবেদনা রইল।”
সোমবার সকালেও আবহাওয়া প্রতিকূল জলপাইগুড়িতে। উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় ঝোড়ো হাওয়া বইছে। আকাশের মুখ ভার। মাঝেমধ্যেই আকাশে বিদ্যুতের ঝিলিক দেখা যাচ্ছে। রবিবারের দুঃসহ স্মৃতি, আবার ফিরে আসবে কি না, সেই আশঙ্কা ঘিরে ধরছে স্থানীয়দের মনে। এই আবহেই চলছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা।