বাংলা এক নতুন ব্রিগেড দেখল রবিবার। রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের ‘জনগর্জন সভা’য় ছিল বেশ কিছু চমকও। মঞ্চের বহর থেকে শুরু করে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দলের সর্ভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের র্যাম্পে হেঁটে কর্মী-সমর্থকদের কাছে পৌঁছে যাওয়া, মঞ্চ থেকেই ভোটের প্রার্থিতালিকা প্রকাশ এবং সেই প্রার্থীদের সঙ্গে নিয়ে তৃণমূলনেত্রীর র্যাম্পে হাঁটা— সব মিলিয়ে ব্যতিক্রমী এক ব্রিগেড সমাবেশ দেখল রাজ্য। পাশাপাশি, বক্তাতালিকাতেও ব্যতিক্রমের রাস্তায় হেঁটেছে তৃণমূল। বক্তাদের তালিকায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মাধ্যমেই একটি সর্বধর্ম সমন্বয়ের বার্তা এবং এক হয়ে এই নির্বাচনে লড়াইয়ের বার্তা দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছে। বক্তাতালিকায় যেমন ছিলেন জনজাতি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি, তেমনই ছিলেন শিখ, খ্রিস্টান প্রতিনিধিরাও। মমতা এবং অভিষেক ছাড়াও মঞ্চে বক্তাদের তালিকায় ছিলেন আরও সাত জন। মন্ত্রী বিরবাহা হাঁসদা, ফিরহাদ হাকিম, রাজ্যসভার সাংসদ মমতাবালা ঠাকুর (মতুয়া), গোয়া তৃণমূলের ইন-চার্জ তথা প্রাক্তন ক্রিকেটার কীর্তি আজাদ (মৈথিলি), শিখ নেতা জার্নেল সিংহ, সিতাইয়ের বিধায়ক জগদীশ চন্দ্র বর্মা বাসুনিয়া (রাজবংশী), নাগরাকাটার তৃণমূল সভাপতি সঞ্জয় কুজুর (খ্রিস্টান)। এই সাত বক্তার মধ্যে কেউ হিন্দিতে বলেছেন, কেউ আবার বলেছেন বাংলায়। তবে খুব সীমিত সময়ের মধ্যে বক্তৃতা সারতে হয়েছে তাঁদের। কীর্তি আজাদ, সঞ্জয় কুজুর এবং জার্নেল সিংহ হিন্দিতে বলেছেন। বাকিরা বলেছেন বাংলায়। তবে বিরবাহা হাঁসদা বক্তৃতা করেছেন সাঁওতালি এবং বাংলায়। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন সকলেই। মূলত বাংলার প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনা নিয়ে সরব হয়েছেন তাঁরা। এ ছাড়াও সন্দেশখালি প্রসঙ্গ উঠে এসেছে দু’জন বক্তার কথায়। বক্তৃতার নিরিখে মমতা-অভিষেককে বাদ দিয়ে বাকি সাত জনকে আনন্দবাজার অনলাইন ১০-এর মধ্যে কত নম্বর দিল?
জগদীশচন্দ্র বর্মা বাসুনিয়া— সভার প্রথম বক্তা সিতাইয়ের তৃণমূল বিধায়ক। বক্তৃতার শুরু থেকেই তিনি কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন। বাংলাকে কেন্দ্রের বঞ্চনা, ১০০ দিনের কাজ, আবাস যোজনার মতো বিষয়গুলি তুলে ধরেছেন। দেড় মিনিটের বক্তৃতার মধ্যে কেন্দ্রের বঞ্চনার কথাই ছিল বেশি। সুর চড়ালেও, সে ভাবে সুর বাঁধতে পারেননি তৃণমূল বিধায়ক। আনন্দবাজার অনলাইনের বিচারে তাই জগদীশচন্দ্র পাচ্ছেন ১০-এ সাড়ে ৩.৫।
বিরবাহা হাঁসদা— রবিবারের ‘জনগর্জন সভা’য় তাঁর বক্তব্যের ঝাঁজ ছিল যথেষ্ট। জনজাতি সম্প্রদায়ের জন্য সাঁওতালিতে যেমন বক্তৃতা করেছেন, তেমনই বাংলায় বক্তৃতার ক্ষেত্রেও ছিলেন সাবলীল। সাঁওতালিতে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে যেমন সরব হয়েছেন, জনজাতিদের অধিকার নিয়ে তাঁর শুরু থেকেই বেশ চড়া ছিল। পাঁচ মিনিটের বক্তৃতায় সাবলীল ভাবে দু’ভাষাতেই বলে গিয়েছেন। জনজাতিরা তাঁদের অধিকার বুঝে নিতে যে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবেন, সেই হুঁশিয়ারিও শোনা গিয়েছে বিরবাহার কণ্ঠে। সব মিলিয়ে, রবিবার ‘জনগর্জন সভা’র মঞ্চে বিরবাহা যথেষ্ট সাবলীল। আনন্দবাজার অনলাইনের বিচারে ১০-এর মধ্যে তিনি পাচ্ছেন ৭।
কীর্তি আজাদ— বাংলাতে তিনি বলতে পারেন না, বক্তৃতার শুরুতেই তাই তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন। তবে আশ্বাস দিয়েছেন পরের বার যদি সুযোগ আসে, তিনি বাংলাতেই বলবেন। হিন্দিতেই বক্তৃতা করেছেন। সময় নিয়েছেন তিন মিনিটের কিছু বেশি। ওই সময়ের মধ্যে তাঁর বক্তব্যের বেশির ভাগ জুড়েই ছিল কেন্দ্রের বঞ্চনা। তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছে, ২০১৪ সালে ‘মোদীজি কি গ্যারান্টি’র মতো শব্দ। সেই গ্যারান্টি পূরণ করতে পারেননি মোদী। কিন্তু দিদির (মমতা) ওয়ারেন্টি প্রতি বছর চলবে বলেও দাবি করেছেন তিনি। বাংলার বঞ্চনার বিরুদ্ধেও আওয়াজ তুলেছেন তিনি। বক্তব্যের ধার, ভারের বিচারে আনন্দবাজার অনলাইনের বিচারে তিনি ১০-এর মধ্যে পাচ্ছেন ৫.৫।
মমতাবালা ঠাকুর— চার মিনিটের মতো বক্তৃতা করেছেন। খুব একটা সাবলীল ছিলেন না। বক্তৃতা করতে গিয়ে একটু-আধটু হোঁচটও খেয়েছেন। নারী নির্যাতনের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মণিপুর এবং হাথরসের উদাহরণ টেনে এনে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপিকে আক্রমণ করেছেন। তবে তাঁর বক্তৃতার বেশির ভাগটাই ছিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর এবং তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে। আনন্দবাজার অনলাইনের বিচারে তিনি ১০-এর মধ্যে পাচ্ছেন ৪।
সঞ্জয় কুজুর— হিন্দিতে বক্তৃতা করেন। তিন মিনিটের বক্তৃতার মধ্যে ছিল তরাই এবং ডুয়ার্সের চা-শ্রমিকদের কথা। বিজেপি বা কেন্দ্রের বিরুদ্ধে একটি বাক্য ব্যয় করেননি। তবে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে চা-শ্রমিকদের দুর্দশা উঠে এসেছে তাঁর বক্তব্যে। আর চা-শ্রমিকদের উন্নতি এবং তাঁদের পরিবারের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের ভূমিকার প্রশংসা শোনা গিয়েছে তাঁর কণ্ঠে। অল্প সময়ের বক্তৃতা করেছেন। কিন্তু সপ্রতিভ দেখা যায়নি তাঁকে। আনন্দবাজার অনলাইনের বিচারে তিনি ১০-এ পাচ্ছেন ৩.৫।
ফিরহাদ হাকিম— পাঁচ মিনিটের কিছু বেশি সময় বক্তৃতা করেছেন। শুরু থেকেই বিজেপি এবং কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন। কখনও চড়ায় তুলেছেন স্বর, কখনও কটাক্ষের সুরও শোনা গিয়েছে তাঁর কণ্ঠে। তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছে ১০০ দিনের কাজের বকেয়া টাকা, সিবিআই, ইডি তল্লাশির কথাও। সন্দেশখালি নিয়ে তিন-চারটি বাক্য ব্যবহার করেছেন। সন্দেশখালির ঘটনায় শিবু, উত্তম এবং শাহজাহানকে গ্রেফতারে রাজ্য পুলিশকেই কৃতিত্ব দিয়েছেন তিনি। নারী নির্যাতন নিয়ে মণিপুর, হাথরস এবং কানপুরের প্রসঙ্গও উল্লেখ করেছেন ফিরহাদ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যের নেতৃত্বে বাংলা অনেক সুরক্ষিত বলেই মন্তব্য করেছেন। ইডি, সিবিআই দিয়ে যে তাঁকে ভয় দেখানো যাবে না, সে কথাও বলেছেন ফিরহাদ। সব মিলিয়ে, আক্রমণের ঝাঁজ ছিল তাঁর বক্তব্যে। আননন্দবাজার অনলাইনের বিচারে তিনি ১০-এ পাচ্ছেন ৬।
জ্ঞানী জার্নেল সিংহ— বাংলা এবং পঞ্জাবের বঞ্চনা নিয়েই মূলত বলেছেন। কী ভাবে বাংলা এবং পঞ্জাবকে নরেন্দ্র মোদীর সরকার বঞ্চিত করছে কয়েকটি উদাহরণ দিয়েছেন। সন্দেশখালি প্রসঙ্গও উঠে আসে তাঁর বক্তব্যে। তবে সন্দেশখালির অশান্তি নয়, এই অশান্তি থামাতে গিয়ে যে আইপিএস আধিকারিক যশপ্রীত সিংহকে খলিস্তানি বলার যে অভিযোগ উঠেছে, তা নিয়ে সরব হয়েছেন। কী ভাবে ঘৃণার রাজনীতি ছড়ানো হচ্ছে, সেই প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন। তাই এই ঘৃণার রাজনীতিকে হারানোর ডাক দিয়েছেন জার্নেল সিংহ। আনন্দবাজার অনলাইনের বিচারে তিনি ১০-এর মধ্যে ৩.৫ পাচ্ছেন।